(উৎসর্গঃ- যাদের নাম এই লেখাটিতে নেই, অথচ থাকলে লেখাটি আরো একটু সম্পূর্ণ হতে পারতো সেই
মুকুট ভট্টাচার্য, স্বর্ণেন্দু সরকার, চিত্রকর প্রভাত মিশ্র এবং অন্যান্য গান্ধর্বদেরকে।)
"I keep thinking about this river somewhere,
with the water moving really fast. And these two people in the water, trying to
hold onto each other, holding on as hard as they can, but in the end it's just
too much. The current's too strong. They've got to let go, drift apart. That's
how it is with us. It's a shame, Kath, because we've loved each other all our
lives. But in the end, we can't stay together forever."
~ Never Let Me Go (2005), Kazuo Ishiguro.
কফি হাউসে
ঢুকেই প্রথম রো-তে দেয়াল
ঘেঁসে, পিছন দিক থেকে তিন নম্বর বা চার নম্বর টেবিল,
রবীন্দ্রনাথ (ছবি) থেকে কিছুটা দূরে,
ওই যে বিকেলের দিকে,
যে টেবিলগুলোতে সূর্যাস্তের আলো,
সরাসরি ফোকাস ক'রে পড়ে আর সিগ্রেটের ধোঁয়া (ঈষৎ নীল মনে হয়) ও সেই ফোকাসের আলো, মানুষের অজানা কোনো খেলা করে,
সেরকমই একটা টেবিলে বসে ‘তোমাকে’ কবিতাটি আমি অয়ন, জয়দীপ এবং আরো কয়েকজনকে শোনাই। কবিতা শেষ হলে,
এবং কবিতাটি অন্য একটি পত্রিকায় দেয়া হয়ে গেছে শুনে,
অয়ন ব্যাজার মুখে বলে,
“বাল! ভালো লেখাটা দিয়ে দিলি!”
এই যৌন-কেশ সম্বোধক শব্দটি শুনে,
আমি বুঝি, কবিতাটি অয়নের পছন্দ হয়েছে এবং কবিতাটি গান্ধারে ছাপার
উপযুক্ত। যেহেতু গান্ধারে যাবার সম্ভাবনা আগেই নষ্ট হয়ে গেছিল,
কবিতাটিকে, ফলত আমি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান দিই। আমার বইয়ের প্রথম কবিতা নির্বাচিত ক'রে।
তখন যারা
নব্বইয়ের সেলেব্রিটি কবি, তারা আজো সেলেব্রেশান বজায় রেখেছেন—
প্রায় কেউই গান্ধারে লেখেননি। বলা ভাল, লিখতে ডাকা হয়নি। এটা বারো পয়েন্ট হরফে, অয়ন লিখেও দিয়েছিল, গান্ধারের উল্টোপাল্টা নেখাজোখার কোনো এক পাতায়। বাস্তবিকই 'গান্ধার' সেই ইউনিকর্ন, যে অণ্ডকোষ ঘষটাতে ঘষটাতে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের দিকে নব্বইয়ের শোভাযাত্রাকে
একটা ঢুঁ মেরেছিল। এমন নয় যে এতে বিরাট কোনো কার্যসিদ্ধি হয়েছিল। বস্তুত গান্ধারের ঘরের ‘লোক’ (এখানে ইনভার্টেড কমার নিশ্চই কোনো মানে আছে,
এখন মনে ক'রতে পারছি না!) জয়দীপ তখন পর্যন্ত যে মোট ১৯/২০-টি কবিতা লিখেছে, আমার ধারনা তার ১০/১২-টি কবিতা 'দেশ'-এ ছাপা হয়েছে। মানে একটি পত্রিকার নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ জয়। বলাই-বাহুল্য
আমার এ পদক নেই। কবিতা লিখে আমার যে একমাত্র মেডেল,
'গান্ধার'-এ লেখা (বা কখনো “দেশ”-এ না-লেখা), তাকে আজও আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি—
পুরনো ছবির এ্যালবামে রাখা,
ধ'রে আসা রং এবং কোথাও কোথাও সেলোফেন পেপারে লেগে যাওয়া,
শিশুসুলভ উজ্জ্বলরঙের ‘আমার যৌবন’ ব্যাজ পরিহিত ফোটোগুলোকে,
নির্জন দুপুরে
যৌন-নিঃসঙ্গ বৃদ্ধেরা যেমন ক'রে দেখে।
২
এখানে দু-চার কথাই বলবো আমি গান্ধার সম্পর্কে। কেন-না দুই
আর চারের মাঝখানে সংযোগ রক্ষাকারী যে ক্ষুদ্রতম সরলরেখাটি বিদ্যমান,
একটু না-ভেবে দেখলেও বোঝা যায় সে আসলে তিন-কে
অস্বীকার ক'রছে বা ক'রতে বাধ্য করেছে। অথচ কে না জানে এই ফাঁকটুকুতেই থেকে যাবে, 'গান্ধারে'র প্রকৃত স্বজাত্যাভিমানের অফহোয়াইট মেঘপুঞ্জ বা ওরকমই
কাশফুল (কোলকাতায়,
মানে বেলেঘাটায় আমি নিজে দেখেছি,
কাশফুল!), ছেলেমানুষি নৈশ-সড়কে নিষ্পাপ চাঁদের আলো, তাদের দর্শকহীন অথবা ভিজিটর-রেস্ট্রিকটেড একক প্রদর্শনীর এক্সপ্রেশনিস্ট ফুলদানি
যা আজও বিক্রি হয়নি।
বিপ্লব (চৌধুরী) আমাদের
মধ্যে ছিল, এইটুকু ছাড়া বিপ্লব আমাদের মধ্যে কোথাও ছিল না। কোন কাব্য-আন্দোলনকে 'গান্ধার' (আনঅফিসিয়ালি) মনেই করেনি, ওগুলো কিছু হয়েছে। বাংলা কবিতা লেখার জন্য নতুন কোনো বাংলা ভাষা তৈরি (আবিষ্কার),
আমরা হয়ত সচেতন ভাবেই করতে চাইনি। বাংলা ভাষার উদারতা এই যে, ইনভেনশন আর ডিসকভারি দু'জনকেই সে আবিষ্কার নামে ডাকার
সুযোগ দেয়। আর দেবে নাই-বা কেন। সত্যেন বসু কণাবিজ্ঞানের ভাস্কো দ্য
গামা হয়ে খুবই প্রিমিটিভ সব রিসোর্স
(এক্ষেত্রে রুলটানা খাতা এবং পেন্সিল) নিয়ে
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি নতুন ভূখণ্ডে (পরে নাম হয়েছে
‘বোসন’)-একটু পদস্পর্শ দিয়ে এলেন। এই চিহ্নিতকরণ বা সব প্রকৃত ‘আবিষ্কার’, কি এই একই শ্রেণীর নয়?
কিন্তু পাঠক আপনি ভুলবেন না,
বাঙ্গালী (ইন্দুমাধব মল্লিক) প্রেশার-কুকারও আবিষ্কার করেছে। আর করেছেই
তো। তার আগে তো এই বস্তুটি ইহজগতে ছিল না। সুতরাং, শুধু আমাদের প্রজন্ম নয়, আমাদের আগে বা পরে অনেক ‘কবি’-ই প্রেশারকুকার মার্কা একটি বিশিষ্ট কাব্যভাষা আবিষ্কার
ক'রে নিতে চেয়েছে। আমি বা আমাদের অনেকেরই দূর থেকে এদেরকে দেখে,
মনে হয়েছে (যাঃ সত্যি সত্যি মনে হয়নি!) বলি,
ওগো হবু-কবি, তোমার কাব্য-ভাষাটি, তোমার অণ্ডকোষদ্বয়ের মতোই,
তুমি নিয়েই জন্মেছ। ছাল-চামড়া
খুলে এখন নতুন কিছু করতে যেও না। বাস্তবিকই
যৌনতা যেমন কাউকে আবিষ্কার করতে হয় না। যৌনতা হয়। কবিতার ভাষাও তেমনি। তাকে কবিতা
থেকে আলাদা করা যায় নাকি! পুরোপুরি অহেতুক এই প্রসঙ্গ শেষ করতে গিয়ে আমার কেন যেন মনে হল কেউ কেউ বোকার
মতো “ঝরা পালক” আর “ধূসর পাণ্ডুলিপি”-র উদাহরণ টেনে আনবেন। তাদেরকে কবি-জ্ঞান করে বলি “আপনি জীবনানন্দ নন।”
এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ, একে আবিষ্কার নয়,
পুনরাবিষ্কার বলে। নিজেকেই।
৩।
"More fundamentally, I'm interested in
memory because it's a filter through which we see our lives, and because it's
foggy and obscure, the opportunities for self-deception are there. In the end,
as a writer, I'm more interested in what people tell themselves happened rather
than what actually happened."
~ Kazuo Ishiguro
এক-দুই-তিন-চার-এর তিন নম্বরটা নিশ্চই মনগড়া। অল্পবয়স থেকেই আমি ডিমনেশিয়ায় ভুগছি। আমি ভুলে যাই। এই ভুলে যাওয়াটুকুই আমাকে কল্পনা করার সুযোগ দেয়। ইন ফ্যাক্ট আমি এই লেখাটা হয়ত লিখছি না, কল্পনা করছি আর আপনিও পড়ছেন না,
আমি কল্পনা করছি, আপনি পড়ছেন। হ'তে পারে আমার কল্পনাশক্তিই আমার স্মৃতিধারণ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। আর সেই ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বেড়ে উঠেছে ফুলবতী ধুতরো, মানুষ-প্রমাণ বনতুলসী। ছোটো ছোটো কড়ে আঙ্গুল মাপের গিরগিটি খেলে বেড়াচ্ছে তার ডালে। এই-রকম
একটা “সৃষ্ট পৃথিবীর গান” আমরা গেয়েছি শুরুর সেই আদিম যুগে। মানুষ যখন সবে হাঁটতে শিখে কফিহাউসে ঢুকে পড়েই নিজেকে সবশুদ্ধ কবি ভাবতে শুরু
করেছে এবং জেনেছে এই সভ্যতাকে বাঁচিয়ে শুধু কবিতাই রাখতে পারবে। এলন মুস্ক (স্পেস-এক্স) তখন কোথায়?
সুপ্রিয় পাঠক, তাই বলে আমি কিন্তু মিথ্যা বর্ণনা করছি না। আমি যদি কিছু মনগড়া লিখেও থাকি, সে তবে মনগড়া। মন দিয়ে গড়া। মিথ্যে নয়। শুধু বলার
এই যে,
যৌবনের বেঁচে থাকার গল্প ঐকান্তিক সফলতায়,
খুব বেশী কেউ লিখতে পারেনি,
আর আমার সে যোগ্যতাও নেই। কেন-না সময়, রাজার
মতো নয়, সময় সম্রাটের মতো। তার সামান্য
কুশীলব হিশাবে আমি এতক্ষণ যা লিখেছি বা যা লিখবো, সব তারই স্বভাব-চরিত্র নিয়ে। তো আমরা
তখন যারা 'গান্ধারে'র ছাতার তলায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম,
তারা কেউ-ই কিন্তু গান্ধারের ছাতাকে,
বাংলাবাজারের রোদ-জল-বৃষ্টি থেকে বাঁচবার জন্য ব্যবহার
করিনি। যে যার নিজের শর্তে লিখেছি (বেঁচেছি)। ফলে অয়ন দেশ-এ লিখেছে, অনির্বাণের 'আনন্দ' থেকে বই বেরিয়েছে,
জয়দীপ বেশ কিছুদিনের জন্য লেখা ছেড়ে দিয়েছিল এ্যান্ড
দ্য লিস্ট গোজ অন।
অনির্বাণের
প্রথম বই ('গান্ধার' থেকে) 'আহিরিটোলা'-র উৎস্বর্গপত্রে তিনজনের নাম। সৌরভ পাণ্ডে, অনুপ সেনগুপ্ত, অয়ন চক্রবর্তী। সৌরভদা’র লেখা শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ে না। সম্ভবত বছর কুড়ি আগে, গান্ধারেই শেষ দেখা। অয়ন বলেছিল, ইচ্ছে করলে এখনো বলতে পারে (এখানে একটা অবধারিত ইমোজি ছিল,
কিন্তু যে কোন 'মহৎ' লেখকের মত আমিও ওসব ব্যবহার করি না
যদিও!), আমার আর সৌরভদার কল্পনাশক্তি সবচেয়ে বেশী। সৌরভের ক্ষেত্রে একথা একশ শতাংশ সত্যি। এখন যেমন মহাজগৎ কথার চল হয়েছে, মানে একটা পরা-বাস্তব ট্রেন্ড, সেখানে যে কোন ইমেজারি,
কোলাজ, মেটাফর, বিশেষণ ব্যবহার করা চলে। গা ছম গা ছমে সব লেখা। এই সব আধিভৌতিক
শশ্মান-সিঁদুর মাখা ও করোটি মার্কা ন্যারেটিভ,
আমার ধারণা, ইচ্ছে করলে এরকম লেখা,
সৌরভদা, প্রতি পাঁচ মিনিটে একটা করে বিয়োতে পারতো। অনুপদা (সেনগুপ্ত) তো তখনকার বাংলা
কবিতার আমির খান। বছরে বড় জোর খান পাঁচেক লেখা। তার মধ্যে তিনটে গান্ধারে।
কিছুদিন
আগে ওপার বাংলার এক কবি বললেন তার নাকি গুচ্ছের কাগজ খাতা কলম ইত্যাদির দরকার হয়,
বিফোর হি ব্লিডস অন দ্য ক্যি বোর্ড। একথা শুনে অনির্বাণ এবং অয়ন বলতেই পারে বা পারতো যে কবিতা লেখার জন্য যে দুটো
জিনিসের দরকার-ই নেই
তা হল কাগজ আর কলম। অনির্বাণের
'আহিরিটোলা' আর অয়েনের 'মায়া' দুটো বই-ই দাড়ি কমা সেমিকোলন, মায় সূচিপত্র মাথায় করে ওদেরকে কফি হাউসে আসতে দেখেছি। অনির্বাণ তো উৎপলকুমার বসুর গদ্যকবিতাও একবার পড়ে,
বা চক্ষু দিয়ে স্ক্যান করে,
পরে সেই কবিতা আমাদের যতিচিহ্নসহ শুনিয়েছে। মনে পড়ে শোভনের (ভট্টাচার্য) স্মৃতিশক্তিও ছিল অসামান্য। শোভনও একটার পর একটা কবিতা শোনাতে পারতো। ওঁর খুবই বিশ্বস্ত একটা অনির্বচনীয় ভঙ্গি ছিল কবিতা শোনাবার। অনির্বাণ, অয়ন, শোভন, কাউকেই কখনো চোতা বের করে কবিতা পড়তে দেখিনি।
আমার স্মৃতি,
যা এইসব মহীরুহদের পাশে তৃণসমান,
বলে— শোভন একটু পরে জয়েন করেছে গান্ধারে। বিপ্লব চৌধুরীকে উত্তরবঙ্গীয় কোটায় জয়দীপ রিক্রুট করে। যদিও অচিরেই বিপ্লব তার যোগ্যতা প্রমাণ করে বা করে চলেছে। এরকম আমার পেডিগ্রী ছিল, সম্ভবত বিনয় মজুমদারের প্রতিবেশী হবার সৌভাগ্য। দলবেঁধে ঠাকুরনগরে আমাদের বাড়ি এবং সেখান থেকে বিনয়দার সাথে দেখা করতে যাওয়া,
এসবও ঘটেছে। তখনকার আমাদের মনে হয়েছিল, বাংলাভাষায় জীবনানন্দের পরে মাত্র আড়াইজন কবি এসেছেন। শক্তি, উৎপল, বিনয়, এই তিনজনকে নিয়ে আড়াই জন কবি। কদাচিৎ
এই আড়াই,
তিন হয়েছে। শুভাশীষের
প্রিয় প্রণবেন্দু বা কখনো আমার প্রিয় ভাস্কর চক্রবর্তীকে নিয়ে। একটা কথা আমার মনে পড়ে,
আমরা যে কোন কারণেই হোক, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, বা 'যৌবন বাউল' গোড়ার দিকে পড়ে উঠিনি। 'যৌবন বাউল' পড়ি
আমি প্রথমবার দেশে ফিরে, অয়নের কাছ থেকে শুনে। তখন গান্ধার বন্ধ হয়ে গেছে। আমি এতক্ষণ
ধরে যা বলতে চাইছিলাম, তা হল, এইরকম একটা স্বরচিত সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্স গান্ধারের
ছিল। তাই কফি হাউসের বড়রা আমাদের খুব পছন্দ করেছেন,
এমন কুখ্যাতি আমি জীবনে শুনিনি।
আমরা কী
পেরেছি বা পারিনি সেটা কথা নয় 'গান্ধার' যদি কোনো পাব্লিক লিমিটেড কম্পানি
হ'ত তবে তার ভিশন হিসেবে কোম্পানির চেয়ারম্যানের ঘরে
নিশ্চয়ই লেখা থাকতো, “বাংলা কবিতার মিডিওক্রিটি থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্তি
দেবার মহান দায়িত্ব, গান্ধার আর কারও সাথে ভাগ ক'রে নেবে না।”
৪।
বড়রা যারা
আমাদের টেবিলে এসেছেন বা আমরা গেছি, তাদের মধ্যে মূলত চারজনের কথা মনে পড়ে,
উৎপল কুমার বসু, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল,
মৃদুল দাশগুপ্ত, রাহুল পুরকায়স্থ।
শুভাশীষ ভাদুড়ী, একটু দূরে কোন ফাঁকা টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসাতেন বিপ্লব
মুখোপাধ্যায়কে। শুভাশীষ তো বিপ্লবদা’র (মুখোপাধ্যায়) লেখাও এনে ছেপেছে গান্ধারে। অচ্যুতদা (মণ্ডল) নিজে লেখা দিয়েছেন। হিন্দোলও (ভট্টাচার্য) আসত 'গান্ধারে'র টেবিলে, বহুদূর থেকে, কলকাতার কুমেরু থেকে। এতদূর থেকে আসত বলেই,
নিয়মিত আসত না। বাংলাদেশের
একমাত্র গান্ধর্ব কবির নাম আদিত্য কবির। মানে গান্ধারে
আদিত্য শুধু লেখেইনি, সে গান্ধার-সঙ্গও করেছে। আদিত্য এই সময় ব্রাত্য রাইসু, সুব্রত জর্জ অগাস্টিন ইত্যাদি সবার লেখাই এনে দিয়েছে গান্ধারের
জন্য।
পরে যখন
'গান্ধার' নিয়মিত হ'তে গিয়ে 'জড়ভরত' হ'ল, তখন প্রথম কয়েক সংখ্যায় (হয়ত কয়েকটি সংখ্যাই বেরিয়েছে)
সম্পাদকের জায়গায় বা "অনুপস্থিত সম্পাদক” হিসেবে আমার নাম ছাপা হয়েছে। তা যার নামই ছাপা হোক, অ্যাজ ইউজুয়াল, গোটা কাগজটাই অয়ন করতো। কারা লিখছে, কী লিখছে, আমি খুব কমই জানতাম। বলাই বাহুল্য শেষ প্রচ্ছদের কাঠি-করে লেখাটিও ওঁর।
তো এইসবের
মধ্যেই 'গান্ধার' অনির্বাণের বই ও আমাদের ফোল্ডার করে। একটি সংকলন। একটি ফোল্ডার, যেন ফোল্ডার নয়, একটি ফুলদানি— এরকম একটি প্রচ্ছদও কি ছিল?
মানে কালোর উপরে মডার্ন পেইন্টিং-এ একটি ফুলদানি?
ঠিক মনে পড়ছে না। ছয়জন কবি, প্রত্যেকের একটি করে সেকশান। বিশ্বজিৎ পন্ডা, তাপসকুমার লায়েক, সার্থক রায়চৌধুরী, শুভাশীষ ভাদুড়ী, অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমি।
এভাবেই
যে সুযোগ পেলেই অন্য পাড়ার ভালো প্লেয়ারদের 'গান্ধার' আদরযত্ন ক'রে, ডেকে এনে খেলিয়েছে, সেটা এই তালিকা দেখলেই বোঝা যায়।
৫।
“যুদ্ধ শুরু হল,
শেষ হল, নায়ক নিহত, রাজ্য
শ্মশান
প্রতি গল্প বিশ্বরূপ, মাথামুণ্ডু না বুঝেই কাঁদি,
হায়, অবিদ্যায় ঢাকা থাকল ঋজু পাঠ—যেন তারা
হিমের কুটুম ওই অস্বচ্ছ মানুষজন, গাছপালা, রণক্ষেত্র—
কেন,এর বেশি,সবটা বুঝিনি?”
(উৎপলকুমার বসু, বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে, ভূমিকা, ২০০৪)
শেষ করব
একটা গবেষণা বা “বিড়াল-এষণা”র কথা লিখে। সম্প্রতি একটা রিসার্চে দেখা গেছে, একটা বিড়াল, ৭ তলা থেকে না পড়ে, ১২ তলা থেকে পড়লে তার সার্ভাইভাল চান্স বেড়ে যায়। কেন সাততলা থেকে পড়লে অবধারিত মৃত্যু? সাততলা থেকে পড়ে একটা বিড়াল মাটি ছোঁবার জাস্ট একটু আগেই টার্মিনাল
ভেলোসিটিতে পৌঁছায়। তারপর আর
কী! মৃত্যুই সবচেয়ে সহজবোধ্য। কিন্তু বিড়াল যদি আরো ৫ তলা তার ভাগ্যে জুড়ে নিতে পারে,
তবে সাততলা পর্যন্ত পড়বার পর,
টার্মিনাল ভেলোসিটিতে পৌঁছে সে বুঝে যায় আমি মরছি,
মানে যদি এরকম ভাবেই পড়তে থাকি। তখন বিড়াল তার পেশীগুলিকে রিল্যাক্সড করে ফেলে। প্রায়-অনন্তের
দিকে এই অভিযাত্রা সে উপভোগ করে। প্রাণভরে
নিঃশ্বাস নেয়। তারপর মাটি ছুঁয়ে সে বোঝে,
নক্ষত্রহীন কালো রাত্রির চূড়াটি এখান থেকে আরো কিছুটা
দূরে। তো এই লেখাটি লিখতে গিয়ে,
আমার নিজেকে সেই বিড়াল মনে হয়েছে। সাততলা থেকে যে পড়ে যাচ্ছে। স্মৃতিভ্রংশতার
কারণে যার অপমৃত্যু হল। লেখাটি প্রথম প্যারাগ্রাফটি লিখেই এটা আমি বুঝতে পারি। 'গান্ধার' থেকে আমার দূরত্ব এখনো ১২ তলায় পৌঁছায়নি। কুড়ি-বাইশ
বছরে এখনো সাততলাতেই থেমে আছে।
#
#
পৌরসভা
থেকে দূরে পরিত্যক্ত বাড়ির জানালা চেপে ধরা কচুবন, জলাঘাস...মাথার উপরে তার যেরকম অনিবার্য একটি
প্রান্তিক মেঘ—দলছুট, ওরকম কবেকার ঘুঘুর ডাকের মতো
কোমল নির্জন একটি মেয়ে, যে দুঃখ দিতে আমাকে কখনো চায়নি সেভাবে— তবু তারই চোখের দিকে চেয়ে, সম্ভাব্য অসম্ভবকে চিনে ফেলে, দুপুরের নরম বাতাসে টগর ফুলের
গাছ থেকে বাড়িটির ভাঙ্গা চাতালের ’পরে ঝরে পড়ছে বিষণ্ণ শাদা
ফুল। তবু এখানেই শেষ নয়। তারপর মেয়েটি বাড়িটির পিছনের দিকে একটি জীর্ণ ট্যাপকল খুলে দেয় আর সেই কল থেকে
জল নয়, অজস্র রঙ্গীন প্রজাপতির একটি প্রবাহ বেরিয়ে আসে। “একটি চৈতন্য প্রবাহ”— গান্ধারের দিনগুলির দিকে ফিরে তাকালে
আমার কেন জানি, এরকমই মনে হয়।