হাসপাতালের গল্প
কিছুদিন পরেই হয়তো ছুটি পাবো। হয়তো বা পাবো না।
হাসপাতালের বাইরে যে নাম না জানা উঁচু গাছটি আছে, যার বড় বড় হলুদ পাতা, তার ডালে
বসে থাকা প্রতারক কোকিলটি আমার বড় চেনা। আমাকে দেখলেই সে তারস্বরে চিৎকার শুরু
করে। আমার সব খবর ও রাখে বুঝতে পারি। এদিকে সারা শহর জুড়ে বসন্ত এসে গেছে। আমার
শহরে এখন ফাগুন হাওয়ায় থিরথির কাঁপন। আবির মাখছে সোহাগি মন। মাটির উন্মাদ ঘ্রানের খবর যেমন একজন মত্ত বাউলই দিতে
পারে, তেমনি আমার প্রেমিকের দেওয়া প্রতিটি সবুজ মুহূর্ত আমার বুকের গভীরে এখনো
একটা আস্ত কবিতার ঢেউ হয়ে বেঁচে আছে।
এই শহরের বসন্ত একটু অন্যরকম। হাসনুহানা আর কাঁঠালি চাঁপার গন্ধে ভরা আমার বসন্ত কেটে যায় হাসপাতালের কোরিডোরে। আমার মতো এক
পৃথিবী মানুষের কত বসন্ত কাটে হাসপাতালের
সামনের ফুটপাতে, হাসপাতালের নীল নির্জনে। কি যে এক মারণ ব্যাধি আমাদের চৌকাঠ ছুঁয়ে
বসে আছে!
আমার জেঠু আমার বটগাছ।ঠিক সেই বোটানিক্যাল গার্ডেন এর
বটগাছটির মতো, মনে মনে আমি যার নাম দিয়েছি "মহাকাল"।
জেঠু, যুদ্ধের এক
অক্লান্ত সৈনিক। তাঁর যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল সেই ছোট বয়স থেকে কখনো জোতদার জমিদার
কখনো পুলিশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। আমার কমরেড এখনো যুদ্ধ করে যাচ্ছে এই মারন ব্যাধির
সঙ্গে হাসতে হাসতে। আমার মনে হয় তাঁকে যদি আবার কাঁধে ঝোলা নিয়ে বন জঙ্গল মাঠ
পেরিয়ে হেঁটে যেতে দেখতাম... রক্তভেজা সেই ধ্রুবতারাকে।
আমি জানি এই ধ্রুবতারাটিও একদিন মিলিয়ে যাবেন।নিভে যাবে
নক্ষত্রের আলো।
কিন্তু বোটানিক্যাল গার্ডেনের সেই মহাকাল বটগাছ যেমন তার
মূল গুঁড়িটি হারিয়ে ও রয়ে গেছে তার অসংখ্য ঝুরিতে ভর করে।ছড়িয়ে গিয়েছে, বিস্তৃত
হয়েছে।ঠিক তেমন ভাবেই রয়ে যাবেন জেঠু।ছড়িয়ে পড়বেন আরো আরো।ছড়িয়ে পড়বেন মানুষের মধ্যে
দিয়ে।তোমার মধ্যে দিয়ে, আমার মধ্যে দিয়ে, আমাদের মধ্যে দিয়ে।আমরাই যে সেই বটগাছটির
ঝুরি।
আর দূর থেকে শোনা যাবে-
"ওই দূর ঝর্নার গায়, গহীন বনের নীল ছায়,আহা কত
দিন/এমনি কুয়াশা ভরা রাতে, এমনি শিশির ভেজা পথে চলেছিল সে/অনেক মানুষ নিয়ে সাথে,
সুখি দিনের ইশারাতে চলেছিল সে..."
"তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও
শকতি"-
এ কথার সার্থকতা আমি খুঁজে পেয়েছি আমার কাকুকে
দেখে।জেঠুর প্রতিচ্ছায়ার মতন কাকু, জেঠুর জ্বালানো সেই মশাল থেকেই জ্বালিয়ে নিয়েছে
মশাল।তারপর অন্ধকার চিরে ফেলে, অন্ধকার ছিঁড়ে ফেলে আগুনের আলোয় আমাদের পথ দেখিয়ে,
পথ চিনিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলেছে আগামীর দিকে।
আমার বাবাকে আমি কিছুই দিতে পারিনি। দীর্ঘ সাত বছরের
কারাবাসে থেকেও যে গোলাপ ফুটিয়েছিল, মুক্তির পর সেই গোলাপের চাষ করতে পারেনি
বাবা।বাবার লালচে রঙ তামাটে হওয়ার পেছনে যে দীর্ঘ ইতিহাস আছে তারজন্য আমিও
অনেকখানি দায়ী। যদি তাকে আমি আমার আরোগ্যটুকু দিতে পারতাম, বাবা হয়তো তখন মাকে ডেকে চিৎকার করে বলত, "এবার আমগাছটায় কত
বোল এসেছে তোমার চোখে পড়েনি? " বা "নেড়া শিমুল গাছটা কেমন লালে লাল হয়ে
গেছে দেখোনি বুঝি? আবির এনেছি এসো দুজনে মিলে আবির
মাখি।"
আগামী বসন্তে কি বাবাকে আমি একফোঁটা শিশিরের শান্তি দিতে
পারব? বাবার হাসি মুখটা অনেকদিন দেখিনি।
এটা ঠিক হাসপাতাল নয়, একটা আশ্বাস। এখানে সবাই গোলাভরা স্বপ্নের খোঁজে আসে। যুদ্ধ জয়ের স্বপ্ন! যুদ্ধ এক
অভ্যেস। সেই অভ্যেসে ক্লান্তি নেই, দুঃখ নেই। বেসুরো সুরগুলিকে শুধু আরো একবার সারেগামাপা
এর সাতটি সুরে বেঁধে নেওয়ার এক নিরন্তর চেষ্টা।
যে সুর যেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা র বাশি থেকে ছড়িয়ে
পড়ে হাসপাতালের আনাচ কানাচে...শহরে...পৃথিবীতে...
শুনতে পাই, উই শ্যাল ওভারকাম সাম ডে...
No comments:
Post a Comment