মফস্বলের
এক মধ্যবিত্ত পরিবার। জন্ম হল এক ফুটফুটে কন্যাসন্তানের। মায়ের কাছে শুনেছিলাম এতটাই ফর্সা হয়েছিলাম নার্সিংহোম থেকে একটা টকটকে লাল
টিপ কপালে এঁকে দিয়েছিলেন নার্সদিদিরা। তেমন কোন
ফাঁক ছিল না তার বড় হয়ে ওঠার মধ্যে। বাবা সরকারী
চাকুরীজীবি। মা সুদক্ষ গৃহবধূ হওয়ার পাশাপাশি সর্বগুণান্নিত এক
নারী। মাতামহ ছিলেন আসানসোলের এক নামী ব্যক্তিত্ব, রেলের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও কবি। পিতামহ চন্দননগরের
এক নামকরা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। অতএব শিক্ষিত
পরিবারে এক সুস্থ পরিমন্ডলে তাদের আদর্শে মেয়েটির বড় হয়ে ওঠা। শৈশবটা কেটেছিল অতীব যত্নে । সব ঝড় ঝঞ্ঝাট
থেকে আড়াল করত তার বাবা মা।
মা বাবা
সর্বোতভাবে চেষ্টা করেন সাধ্যমত সবটুকু দিয়ে আগলে রাখার। অথচ যদি কোন অশনিসংকেত লুকিয়ে থাকে পরিবারের মধ্যেই? কোন নিকট সম্পর্কের আড়ালে যদি থাবা বসায় নেকড়ে বাঘ? হয়ত করার কিছু থাকে না অনেক সময়। কারণ সেই
ফুলের মতো শৈশব কিছু বোঝার আগেই বেশ কিছুবার ঘটে যায় কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ধামাচাপা পড়ে যায় অনেককিছুর মতো। অনেক ধুলো, যন্ত্রণা, ঘেন্না সবকিছু নিয়ে বড় হতে থাকে একটা নিপাট নারী শরীর। বয়সের সাথে সাথে বুঝতে শেখে এইসব তিক্ত অভিজ্ঞতা কিভাবে তাকে প্রতিবাদী করে
তুলছে ক্রমশ। একদিন চিৎকার করে নেকড়েদের থাবা থেকে খুলে নিতে শেখে
ধারালো নখ। অভিজ্ঞতাই তাকে নিজের জন্য চিৎকার করতে শেখায়।
অভিজ্ঞতাকে
যদি শিক্ষা ধরে নিয়ে এগোনো যায় তবে জীবনে পথ চলাটা সহজ হয়। এই সিক্ত গিরিখাতের মধ্যে জমানো মনিমুক্তো বা কাঁটার মুকুট আমাদের মাঝে মাঝে
নিয়ে যায় এক অচেনা 'আমি'র সামনে। মুখোমুখি যেখানে আমার ব্যর্থতা না পাওয়া, চাওয়া কিংবা পাওয়া। কে আমি? কি পরিচয়? কোথায় কতদূর আমার সীমা? এর উত্তর
খুঁজে পাওয়ার
জন্য জীবনে প্রয়োজন অভিজ্ঞতার।
খারাপ অভিজ্ঞতার
সাথে সাথে জীবনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো আবার আলোর মতো মাতিয়ে রাখে বাতাস। ফুরফুরে চনমনে তরতাজা একটা আমিকে আবিষ্কার করা যায়। ব্যস্ততায় মধ্যে দুদন্ড বিরতি। প্রসঙ্গত
মনে পড়ে, জীবনে তৃতীয়বার ফার্স্ট হওয়ার অনুভূতি। প্রথমবার স্কুলে যখন ফার্স্ট হই বয়স তখন খুবই কম। এই অনুভূতি অনুভব করার মতো বোধ তখনও হয়নি। মায়ের কাছে শুনেছি ক্লাস ওয়ানে ওঠার সময় প্রথম হই। দ্বিতীয়বার প্রথম হই ক্লাস থ্রি থেকে ফোরে ওঠার সময়। আর তৃতীয়বার সপ্তম থেকে অষ্টমে। আমি বরাবর
স্কুলে দশম স্থানাধিকারীদের মধ্যে থাকতাম ঠিকই তবু প্রথম হব এটা ছিল অপ্রত্যাশিত। তবু যখন প্রধান শিক্ষিকা ক্লাসে এসে ঘোষণা করেছিলেন ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল সে
দৃশ্য আজও আমার সেদিনের বলে মনে হয়। মনে হয় ওই
তো বাবা দাঁড়িয়ে আছেন তার সাইকেল নিয়ে স্কুল গেটের সামনে আর আমি দৌড়ে এসে জাপটে ধরছি
তার গলা। ওদিকে মা অপেক্ষায় ঘর বারান্দা করছেন। আর রেজাল্ট দেখার পর মৃদু হাসিতে নিভৃতে জড়িয়ে দিচ্ছেন আর্শীবাদের ওম।
মা'কে দেখেই মূলত আমার বেড়ে ওঠা। তার মতো
সবদিক সামলে নিজে হাতে অদ্ভুত নিপুণতায় জীবনের সব বাধা অতিক্রম করে চলার ইচ্ছাটাও কোথাও
বেড়ে উঠছিল নিজের অজান্তে। দাদু আসানসোলের
এক স্বনামধন্য কবি হলেও মা কোনদিন লেখালিখিতে উৎসাহ দেখায় নি। কিন্তু এই শখটা অতি অদ্ভুতভাবেই আমারই অজান্তে এল আমার মধ্যে। স্কুলে একবার ম্যাগাজিন বের হবে বলে সকলের কাছ থেকে লেখা চাওয়া হয়। আমিও দিয়েছিলাম। সেই থেকে শুরু। কবে কখন কিভাবে এ আমারও অজানা। বরাবরই ছবিআঁকা, নাচ, গান, পড়াশোনা
নিয়ে থাকতাম। তার মধ্যেই কোথাও চেপে বসেছিল ডায়রী লেখার শখ। স্কুল থেকে চাওয়া অন্য এক ম্যাগাজিনে একবার আমার একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়, তখন ক্লাস সিক্স বা ফাইভ হবে। সে বছর কলকাতা
বইমেলায় বাবা মা'র হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ল সেই ম্যাগাজিনটি বইমেলার
একপ্রান্তে মাটিতে বসা ছোট্ট একটি স্টলে বিক্রি হচ্ছে। কেমন একটা বিদুৎ খেলে গিয়েছিল সারা শরীরে। মনে হয়েছিল ভরা বইমেলার মাঝে প্রত্যেকটা মানুষের সামনে চিৎকার করে বলি ' এই দেখো, আমার লেখা গল্প আছে এই বইটিতে'।
ইচ্ছেরা
কখনও জেদ হয়ে ওঠে কখনও আবার ধামাচাপা পড়ে যায় সময়ের চাপে। আমার পছন্দের নেশা ছিল ছবিআঁকা। অবসর সময়ে
সারা দুপুর জেগে কি অবলীলায় শেষ করতাম কত কত পেন্টিং। কত্থকের বোল তোড়া তেহাই শুনলে নেচে উঠত ঘুঙুর। তার ওপর ভালো স্কুলে পড়ার চাপ। ভালো রেজাল্ট। সব মিলিয়ে দম ফেলার ফুরসৎ নেই।
বন্ধু বান্ধব
ভালোলাগা ভালোবাসা সবই আসে প্রকৃতির নিয়মেই। যা থাকার
থাকে, যা যাওয়ার তাকে যেতে দিতে হয়। কিন্তু এই অসময় এই বিচ্ছেদ এই ভালোবাসা এই প্রেম এই বিরহ এসবকিছুই তো অভিজ্ঞতা। মানুষ চিনতে শেখে বুঝতে শেখে। ঠিক ভুলের
বিচার করতে শেখে।
কিছু সম্পর্ক
থাকে ছোটগল্পের মতো। ফিরে ফিরে আসে বিভিন্ন বাঁকে। এড়িয়ে যায় নদী। পাথর নুড়ির পথ ছাড়িয়ে বহুদূর, তবু তার স্রোতে ছিটকে আসে পাথরের টুকরো। হাত রাখলে, হাতে লাগে অথচ ধরতে গেলে পিছলে যায় শ্যাওলা ধরা গা। সে সব সম্পর্ক শুধু আড়াল বোঝে। নিভৃত পরিচয়
বোঝে৷ তারা কাছে এলে পাথরে পাথরে ঠোকা লাগে। ভেঙে যায়
হাওয়ায়। অভিজ্ঞতা খানিকটা এমনই সিন্দুকে তোলা যত্ন করে রাখা
চিকমিকি পাথর।
জীবনের স্রোতে
বইতে বইতে বাড়ি থেকে দূরে থাকতে হয় একটা সময়। তখন চাকরী করি। ওখানেই। প্রথম মা
বাবার কাছ থেকে বহুদূর। কোন ছায়া নেই। ছাদ নেই। কোল নেই। শুধু টেলিফোনে
দুবার তাদের গলাটুকু শোনা আর পাগলের মতো এক ছায়া আর ব্যস্ততার পিছনে ছুটে চলা। তখনি মনে হল একদিন, আসলে কি
চাই? এটাই কি জীবন চেয়েছিল? যেখানে কেউ সুখী নেই? নাকি আমি
সুখী? প্রকৃত সুখ কি,তার সংজ্ঞা বোধহয় কারো জানা নেই। মানুষ যাকে
সুখ বলে ভাবে যাকে জড়িয়ে জীবনের সংজ্ঞা আঁকতে চায় হঠাৎ যদি সেই পথ ভেঙে টুকরো হয়ে যায়? কাচের দেওয়ালের মতো ছত্রাকার একটা মানুষ ক্ষতবিক্ষত হতে হতে গড়িয়ে পড়ে ক্রমশ
চরম ডিপ্রেশনে, তবে সুখ কোথায়? কোথায় মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস বা ভরসা? অবহেলা আর ভালোবাসা কোনদিন সমান্তরালে চলে কি?
যেন ঘুম
ভেঙে যায় হঠাৎ। মেডিক্যাল কাউন্সিলিং মা বাবার সান্নিধ্য ফিরিয়ে আনে
নদীর গতিপথ। এ যেন এক অসাধ্য সাধন। অভিজ্ঞতা বুঝিয়ে দেয়, তার চেয়ে
চরম শিক্ষক আর কেউ নয়।
এমন এক ছায়াচরাচরে
উদয় হয় নতুন সূর্য। সে সূর্যের আলো এসে পড়ে নদীর গতিপথে। সে যেন ম্যাজিশিয়নের মতো বদলে দিতে থাকে অক্ষরগুলো। সব অর্থ যে নিরর্থক নয়, অসম্ভবের
মাঝেও লুকিয়ে আছে সম্ভাবনা তা বুঝিয়ে দেয় জলের মতো করে। যেন এক দেবদূত এঁকে দিয়ে যায় রামধনু। বিষণ্ন অভিজ্ঞতার মেঘে হঠাৎ বৃষ্টি আনে হীরের কুচির মতো।
যে নদী হারিয়ে
ফেলেছিল তার অক্ষর, সিন্দুকে ভরা এক জিয়ন কাঠির ছোঁয়ায় হেসে ওঠে তার গুপ্তধন। অভিজ্ঞতার গিরিখাতে জমা হয় আরও কিছু ধনরত্ন।
এরপর পরিবর্তনের
হাওয়া। ঋতুবদলের সাথে পূর্ণতা পায় নারী শরীর। মাতৃত্বের চুম্বনে তখন সিক্ত হচ্ছে তার অন্তর্বাস। সেসময় নদীর গতি মন্দ। ছবিআঁকা
কম। ত্রিতালের গৎভাও চলে গেছে বহুদূর। সারারাত শিশুটির সাথে জেগে থাকা, সময় মতো
খাওয়ানো, তার সমস্ত প্রয়োজনীয়তা নিজে হাতে মেটানো। এ যেন এক অদ্ভুত জগত। চোখ থেকে
মুছে গেছে ঘুম। অবসর বলতে যেটুকু সময় সে ঘুমায়, সেই সময়টুকু নিজের জন্য কিছু ভাবা। এমনি অবসর
দিয়ে গেল এমন সব অক্ষর যা প্রথম মুদ্রিত হল নিজের পরিচয়ে। ২০১৮ সাল। বই আকারে প্রকাশ পেল চুপকথারা। নদীটা আর অবসন্ন হয়না, ক্লান্ত
হয় না তার অভিজ্ঞতার ভারে। কারণ আমার
মা বলত সর্বদা ' অমাবস্যার পরেই আসে পূর্ণিমা' !
অক্ষরজন্ম
যেন এক নতুন ভাবে বাঁচার নাম। ঘরে বাইরে
দোকানে বাজারে যেখানে যা কিছু দেখা, নির্দ্বিধায়
তা তুলে রাখা নিজের ঝুলিতে। আসা যাওয়ার
গতিপথে নানান চরিত্র তাদের রঙ ঢঙ চলন কিংবা গল্প নিখুঁতভাবে এঁকে রাখে সাদা ক্যানভাসে। নদীর একটা গুপ্ত কোটরে। সেখানে লুকানো
থাকে সেই ঝুলি। অক্ষরে ভরে উঠলে সেখানকার দরজা খুলে যায় নিজে থেকে। নদী শুধু বইতে থাকে নিজের ধারায়।
No comments:
Post a Comment