Monday, July 22, 2019

রক্তক্ষরা বুলেটগন্ধ কিংবা লাল পলাশের স্বপ্ন – তারপর??-- জয়ন্ত ভট্টাচার্য








সেটা হাজরা পার্কের কোন এক দুপুরের কথা। বন্দীমুক্তির দাবীতে সুরেশ বিশ্বাস “শত শহীদের রক্তে রাঙ্গা পতাকা” গাইছেন উন্মুক্ত কণ্ঠে, ট্রাম লাইনের আওয়াজকে অতিক্রম করে। সাথে গলা মেলাচ্ছে কৈশোর-যৌবনের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে – জয়ন্ত। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পরিচিত হবার আগে পড়েছ তাঁর ঐ গায়ে কাঁটা দেওয়া কবিতার লাইনগুলো –
পিচ্ছিল নেপথ্যে আজও রয়েছে মানুষ –একা – নরক দর্শন করে
                         তবু অন্ধ নয়, খোঁড়া নয়;
রক্ত মাংস কর্দমের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে, নদী সাঁতরিয়ে
নরক উত্তীর্ণ হতে ক্লান্তিহীন যাত্রা তার; 
মাথা উঁচু রাখাই নিয়ম।
কলেজ স্কোয়ারে খাটো ঝুলের পাজামা আর কোঁচকানো ধূসর পাঞ্জাবী পরা লম্বাটে, রোগাটে কালোর দিকে ঘেঁষা গায়ের রঙের একজন মানুষ তুমি গান করে নেমে আসার পরে বললেন – “বেশ গেয়েছেন ভাই! খোলা উদাত্ত গলা।” ভেতরে কি এক অনুভূতি তখন! জেনে গেলাম এই প্রায়-তাচ্ছিল্য করার মতো ভদ্রলোকের নাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সমস্ত শরীর জুড়ে যে অত্যাশ্চর্য, দ্রিদিম দ্রিদিম অনুভূতির নীল সাগরের মতো ঢেউ খেলে গিয়েছিলো সে মুহূর্তে তাকে কি আবেগ বলে? কোন শব্দে ধরার মতো অবস্থায় ছিলেনা তুমি, জয়ন্ত। তোমার সামনে ঢেউয়ের চূড়ায় চূড়ায় আলোর মতো জেগে উঠছে তাঁরই কবিতাখণ্ড।
আমার সন্তান যাক প্রত্যহ নরকে
ছিঁড়ুক সর্বাঙ্গ তার ভাড়াটে জল্লাদ,
উপরে নিক চক্ষু, জিহ্বা দিবা-দ্বিপ্রহরে
নিশাচর শ্বাপদেরা; করুক আহ্লাদ
তার ছিন্ন ভিন্ন হাত-পা নিয়ে
শকুনেরা। কতটুকু আসে যায় তাতে
আমার; যে আমি করি প্রত্যহ প্রার্থনা,
‘তোমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।”
মণীভূষণ ভট্টাচার্য পাথরে পাথরে, শরীরের শোণিতে-শিরাতে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। কি অত্যাশ্চর্য সব ছবি। জীবনের ছবি, কাদার ছবি, মৃত্যুর ছবি। আবার শেষ অব্দি resurrection-এর ছবি –
অধ্যাপক বলেছিলো। ‘দ্যাট’স র-ঙ্, আইন কেন তুলে নেবে হাতে?’
মাস্টারের কাশি ওঠে, ‘কোথায় বিপ্লব, শুধু মরে গেল অসংখ্য হাভাতে!’
উকিল সতর্ক হয়, ‘বিস্কুট নিইনি, শুধু চায়ের দামটা রাখো লিখে।‘
চটকলের ছকুমিঞা, ‘এবার প্যাঁদাবে শালা হারামি ও.সি-কে।’

উনুন জ্বলে নি আর, বেড়ার ধারেই সেই ডানপিটে তেজী রক্তধারা,
গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিলো তারা।’

জয়ন্ত, তোমাকে উথাল-পাথাল করে দিচ্ছিলো, ছিঁড়েখুঁড়ে টুকরো হয়ে যাচ্ছিলে যখন পড়েছিলে এই পঙক্তি –
‘অন্ধকার বিছানা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসে আলোর বালতি
উল্টে দেবে স্বাধীন শিশু। প্রথমেই ঘুম ভাঙ্গবে মা’র, তারপর
গভীর নিরাপদে একে একে জেগে উঠবে পড়শীরা, বারান্দা থেকে
উঠোনে গড়িয়ে-পড়া শণালী স্রোতের মধ্যে আদুল গায়ে
দুরন্তপনা করবে – সে-ও হয়তো এমনি এক রবিবার।’
শুধু কবিতা পাঠ বা গান করাতে আটকে রইলোনা। জীবনের ধারাপথ বদলে দিলো, জয়ন্ত তোমার। এবার একটু পেছনের দিকে ঘুরে দেখবেনা?
২৫ মে, ১৯৬৭ থেকে ২৮ জুলাই, ১৯৭২ – মাত্র পাঁচটি বছর। আজ থেকে দশক হিসেবে ৫টি দশকের কিছু বেশি, বছরের হিসেবে ৫২, পেরিয়ে এসে তারুণ্যের সে সামুদ্রিক ঊর্মি-কলোচ্ছ্বাস আজ কান পেতে পেতে শোনা বড়ো সহজ নয়, কি বলো জয়ন্ত? তুমিও তো জীবনকে কয়েক বছরের জন্য বাজি রেখে জীবনের উৎসবে মাতোয়ারা হয়েছিলে তোমারই মতন বন্ধুদের নিয়ে। তাওতো ৪ দশক পার হয়ে গেলো। তোমরা তো তোমাদের জীবনে যেমন তেমনি গলায় ঝড়ের খেয়া বাইছিলে – “সেই গান শুনেছি, জীবনকে জেনেছি মৃত্যুই শেষ কথা নয়”। তোমার স্থানিক অভিজ্ঞতা সিঞ্চিত হয়েছে, পলির পরে পলি জমে সঞ্চিত হয়েছে দিনাজপুর আর মালদার মানুষের মাঝে – শহরে আর গ্রামে, ভালোবাসা, “কমরেড” এই বহু কাঙ্খিত ডাক আর বুক দিয়ে আগলে রাখা ওমে। দিনাজপুরের গ্রামে প্রায় তোমার চোখের সামনে শহীদের বার্তা নিয়ে এলো শ্যাম হাঁসদা। নকশালবাড়িতেও প্রথম শহীদ এক ভূমিপুত্র বাবুলাল বিশ্বকর্মা। তুমি দুজনকে নিয়ে গান বেঁধেছিলে – “বাবুলালের খুনে জন্ম নিল অমর শহীদ শ্যাম”। সে গান তোমার গলা ছাড়িয়ে আরো অনেক গলায় ছড়িয়ে গিয়েছিলো গ্রাম থেকে গ্রামে। এদিনগুলো অনেক পরের সময়। এসময়ের আগে আরেক সময় ছিলো। সে অনেকটা গর্ভস্থ সন্তানকে বহন করার আনন্দ, উদ্বেগ, উদ্বেলতা, যন্ত্রণা সব মিলেমিশে ছিলো সেসময়য়ের গর্ভে। প্রস্তুতিপর্ব ঠিক কেমন জানা না থাকলেও এক প্রস্তুতিপর্ব, এক দ্রোহকালের জলছবি তৈরি হচ্ছিল সমস্ত সত্তা জুড়ে, সত্তার পরিব্যাপ্ত প্রকাশ জুড়ে।
তোমার কি ১৯৬৭-র সে দিনটা মনে পড়ে, জয়ন্ত? যেখানে তুমি থাকতে, মানে এক মফঃস্বল শহর রায়গব্জ যেখানে খবরের কাগজ আসতো ৩৬ ঘন্টা পরে, সেখানে খবরের কাগজে খবরটা পড়ে তোমার দাদার কি উল্লাস হয়েছিল? আর তুমি ছিলে তোমার সেসময়ের, সেই ছোট্টবেলার দিনগুলোর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সাথে গলায় গলা জড়িয়ে। তোমাদের কি মনে হয়েছিল, জয়ন্ত?  ৫০ বছর পরে আর কি সম্ভব কি হয়েছিল সেই বিশেষ ক্ষণে হৃদয়ের অন্তস্থলে তা আবার হৃদয় খুঁড়ে তুলে আনা? কিছু একটা হয়েছিল। কোথাও একটা তিরতিরে লুকনো চোরাস্রোত বয়েছিল সেদিন, সে ক্ষণে। কেননা সেদিনের আনন্দবাজার পত্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর ছিল – নক্সালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহের খবর। কিন্তু তোমার দাদা তৎকালীন বিপিএসএফ-এর একনিষ্ঠ জঙ্গী কর্মী। দাদার বেসুরো গলায় “গঙ্গা যদিও মেকং নয় মেকং তোমায় লালসেলাম / এসো গঙ্গা মেকং এক করি এদেশে ভিয়েৎনাম গড়ি” এরকম সব গণসংগীত শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছ। তোমার বাবা অতি সামান্য মাইনের আদর্শবাদী স্কুল শিক্ষক ছিলেন। সেসময়ে মাসে দু’শ টাকাও মাইনে পাননি কোনদিনঅথচ বাড়িতে ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলের (যাদেরকে সেসময়ে নবকংগ্রেসী বলা হত) দুস্কৃতিদের সশস্ত্র গুলি, বোমা, বন্দুকের আক্রমণ থেকে শেল্টার নেবার জন্য একের পরে এক দাদার কলেজের বন্ধুরা, ছোট-মাঝারি-উঁচু মাপের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর কতো কতো গ্রামের মানুষ আসছে, থাকছে, খাচ্ছে। এরা সবাই সিপিএম দলের নিষ্ঠাবান কমিউনিস্ট কর্মী। কেউ স্ব- বা আত্ম-কে কেন্দ্র করে বাঁচেননি, নিজেদের আগামী সঞ্চয়ের জন্য কোন মূলধন জমিয়ে রাখেননি। আত্মাহুতি, মানুষের পেট-ভাত-কাপড়ের লড়ায়ে জীবন বাজি রেখে লড়াই করা, নিজের বিশ্বাস আর জীবনবোধের জন্য সবকিছু বাজি রাখতে পেরে চলা – এরকম চলমান মাথা-উঁচু করে চলা জীবনের চলচ্ছবি দেখেইতো তুমি বড়ো হয়েছ, জয়ন্ত! তোমার বাবা মা? কোন সঙ্গতি ছাড়াই বাড়ির যেসব বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী আছে সেসব লুকিয়ে বিক্রী করে এদের খাবার জোগার হয়েছে। তোমার মা-কে না এক বড়ো নেতা, পরবর্তী সময়ের এক নামী গায়ক তথা সঙ্গীতপ্রতিভা সন্ধানী ব্যক্তিত্ব, বলেছিলেন – আমাদের “গোর্কির মা”! সেসময়েই তো প্রথম তুমি পড়েছিলে ম্যাক্সিম গোর্কির দুনিয়া কাঁপানো উপন্যাস “মা”, বাংলা অনুবাদে। সে এক অন্য জগতের অনুভূতি, কেমন উথালপাথাল করছিল বুকের একেবারে মধ্যিখানে। তোমারও তখন মানুষের যা কিছু করে ক্ষতি করে তার হাত চেপে ধরে “মা”-র পাভেলের মতো বলতে ইচ্ছে করছিল –“ব্যাস, অনেক হয়েছে।”
তুমি বোঝোনি তখন, বোঝার সময় আর ক্ষেত্রও তৈরি হয়নি, আধুনিক ডিসকোর্সের ভাষায় যাকে এখন trace বা ছাপ বলে অ্যকাডেমিক মহলে, সে trace রেখে গিয়েছিল সেসব টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলো তোমার অস্তিত্বেtrace-তো তোমার জীবনের চলচ্ছবি নির্ধারণ করে দিয়েছিল শুধু সেদিনের জন্য নয়, ভবিষ্যতের অনাগত সময়ের জন্যও।
সেদিন জেনেছিলে বুকের বাঁদিকে জামার নীচে থাকে এক ধুকুপুকু হৃ্দপিন্ড, যাকে বলে হৃদয়। সেখানে তখন জীবনের ছোট কুলুঙ্গিতে সঞ্চয়ের বদলে ব্যয়ের আয়োজন বেশি, স্ব-রক্ষার চাইতে বন্ধুর পাশে দাঁড়ানোর জীবন তিয়াসা অনেক প্রসারিত অস্তিত্বব্যাপী, সেখানে জীবন উপচানো আশ্চর্য শস্যকে সামাজিক শস্য বলে গণ্য করা হয়েছিল। আরো অনেকদিন পরে যখন তুমি বড়ো হচ্ছো, খানিকটা লেখাপড়া শিখেছ তখন পেয়েছিলে অত্যাশ্চর্য এদুটি লাইন –
                              সমস্ত আকাশ ভরা আলোর মহিমা
                              তৃণের শিশির-মাঝে খোঁজে নিজ সীমা।
চারপাশে একটা প্রবল কিছু চলছে টের পাচ্ছিলে তুমি। তোমার দাদার বন্ধুরা লুকিয়ে তাদের আত্মরক্ষার জন্য (অন্যদের ক্ষেত্রে আক্রমণের জন্য যদিও! – হাতিয়ারের কি আর জাত বিচার হয়? কে করছে কেন করছে – এটাই তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ) “গুপ্তি”, গ্রেনেড আরো কি কি সব আনতো টানতো। কেমন যেন মনে হত ঐ কিশোর মনে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের গল্পে পড়া রোমাঞ্চ তোমার পরিচিতদের মাঝে দেখতে শুরু করলে। দিয়েন বিয়েন ফু-র কাহিনী তোমার সবুজ-মাখা চোখে কি অসম্ভব উজ্জ্বলতা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তুমি চোখের সামনেই দেখতে পেতে সেই প্রকান্ড লম্বা টানেল আর যোদ্ধাদের। তোমার বন্ধুরাও কি পেতো?
তোমার কিশোর মনে বারেবারে এসেছে – কিছু একটা ঘটছে। তোমার চোখের সামনে দেখলে ভোটের সময়ে চোয়ারে, হিংস্র চেহারার কিছু যুবক খোলা স্টেন গান নিয়ে (সি আর পি, পুলিশের চোখের সামনে) বুথ বন্ধ করে দিয়ে ভোটারদের বের করে দিল। ২০১৭ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে বলে তোমার বাবা শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাইকে দেখে সমীহ নিয়ে কথা বলেছিল স্টেন গান আড়ালে রেখে। এখন মনে হয় তখনো খানিকটা সামাজিক বোধ বুঝি ক্রিয়াশীল ছিল।
কোথাও কি তোমার আর তোমার সেসময়ের প্রাণ-প্রতিম বন্ধু প্রবীরের তখন মনে হয়েছিল যে আমরা সবাই কোন না কোনভাবে অন্তরিন? মনে পড়ার মতো বয়সই তো হয়নি তোমাদের। কিন্তু অনেকদিন পরে যেদিন “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না” যেদিন পড়েছিলে সেদিন বুকের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ ফুলে ফুলে উঠছিলো, ভেঙ্গে ভেঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তোমাকে –
                        এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
                        এই জহ্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
                        এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
                        এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
                        আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেবো
                        ……
                                                ভালোবাসা – যার থেকে আলোকবর্ষ দূরে জন্মাবধি অছ্যুৎ হয়ে আছি –
                        তাকেও ডেকে নেবো কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন
তোমার কৈশোর, রায়গঞ্জের পরিচিত প্রাণস্ফূর্তিতে উচ্ছ্বল জীবন প্রবাহের দিন একসময়ে শেষ হল। প্রায় ৪৫ বছর আগে যেরকম রেজাল্ট করলে গ্রামাঞ্চল থেকে খোদ ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া যায় সেরকম এক পরিস্থিতিতে কলকাতায় এসে উপস্থিত হলে তুমি। হাওড়া স্টেশনে দেখলে দেয়াল জুড়ে বড়ো বড়ো করে লেখা আছে – “জরুরী অবস্থা মানে অনুশাসন”। কোন এক ত্রিকালজ্ঞ ঋষির কথা ছিল সেটা, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ঘনিষ্ঠ। মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে জানলে কিছু ছাত্র ইউনিয়নের দাদাদের হাতে মার খাচ্ছে। ওরা নানারকম কথা বলে – জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধে, ডাক্তারকে রোগীর আরো কাছে যাবার কথা বলে, বলে এক বিদেশী সার্জন নর্ম্যান বেথুনের কথা। কৃতবিদ্য নর্ম্যান বেথুন চীনে যুদ্ধের সময়ে সামনে থেকে আহত কমিউনিস্ট যোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছিলেন। এসব কথাও নাকি তিনি বলেছিলেন – ডাক্তারের কাছে রোগী আসতে না পারলে ডাক্তার যাবে রোগীর কাছে। ওঁকে নিয়ে লেখা “দ্য স্ক্যালপেল, দ্য সোর্ড” বইখানাও দাদারা পড়তে দিল এ বইটাতে পরে আসছি। তার আগে বলতে হবে সেসব মার খাওয়া দাদারা, আমিও যার একজন সাথী ছিলাম, মিলে গড়ে তুললো মেডিক্যাল কলেজ ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (MCDSA) সেদিন জেনেছিলে তুমি আলমা-আটা প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বসম্মেলনের কথা। জেনেছিলে স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। সেদিন সবাই মিলে শ্লোগান তুলেছিলে – “স্বাস্থ্য কোন ভিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য আমার অধিকার”। তোমরা রাজপথে নেমে জানিয়েছিলে স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, ব্যয়বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
কি তুমুল এক স্রোত বইতে শুরু করলো – জীবন, রাজনীতি, জীবনের যাপন, বন্ধুত্ব আর কমরেডশিপের অপরূপ যৌগপদ্যে। কোথায় সাওতালডিহির শ্রমিক আন্দোলন – হাজির আমাদের দল। কোথায় মেদিনীপুরের বন্যা – হাজির আমরা। কোথায় টিবি হাসপাতালের আন্দোলন (এখন যেটা কেপিসি মেডিক্যাল কলেজ হয়েছে) – হাজির আমরা। কোথায় স্কটিশ চার্চ কলেজে ছাত্রদের ওপরে আক্রমণ – হাজির আমরা। আমাদের কণ্ঠে গান – “কমরেড শোন বিউগল ওই হাঁক ছেড়ে, তোল কাঁধে নে জঙ্গী হাতিয়ার” আমরা সর্বত্র। এর মাঝে কলেজে ছাত্র ইলেকশন হল। রেকর্ড ভোট পেয়ে ছাত্র প্রতিনিধি হলাম। আরো জড়িয়ে গেলাম। এবার মন দিয়ে পড়লাম বেথুনের জীবনকাহিনী। অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতা হল। চীনে কমরেডরা তাঁকে আদর করে পাই চু এন বলে ডাকতো। এমন আদর পেতে কে না চায়? আমারও মনের মাঝে আকুলি-বিকুলি শুরু হল। জানলাম এক স্ব-জাত উদ্ভাবনী প্রতিভা বাসা বেঁধেছিল বেথুনের মাঝে। তখনো দুরারোগ্য টিবির চিকিৎসায় নতুন ধরণের সার্জারির উদ্ভাবন করলেন। যে সমস্ত পুস্তক-কেন্দ্রিক সার্জনরা বইয়ের বাইরে যায়না, নতুন পথে রোগীর চিকিৎসা করতে অপারগ তাদের জন্য বললেন – “The surgeon who can’t see the hints and answers the nature and the world thrust into his face should be digging ditches, not massacring the human body.” তাঁর তত্ত্বাবধানে ৭৩টি thoracoplasty (যে অপারেশনে রোগীর ফুসফুসের সার্জারি করা হত টিবি সারানোর জন্য) সহ ৩০০-র ওপরে বড়ো ও ছোট সার্জারি করা হয়েছিল এক বছরে। তাঁর গবেষণাপত্র Canadian Medical Association Journal এবং Journal of Thoracic Surgery-র মতো মান্য জার্নালে ছাপা হয়েছে। চীনে যাবার আগে স্পেনের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। চীনে গিয়ে যুদ্ধের ফ্রন্ট লাইনে blood transfusion-এর ব্যবস্থা করলেন। তাঁর যাপ্য মন্ত্র ছিল – every leader starts by first leading himself. যুদ্ধক্ষেত্রে দিনে ২০টির বেশি অপারেশন করেছেন বেথুন। চীনের মুক্তিসংগ্রামে সবচেয়ে কার্যকরী অষ্টম রুট বাহিনীর তরফে তাঁর মাসোহারা যখন ১০০ ডলার দেবার প্রস্তাব দেওয়া হয় তখন তিনি সটান প্রত্যাখ্যান করেন সে প্রস্তাবতখন একজন কমান্ডার পেতেন মাসে ৮ ডলার, একজন সৈনিক মাসে ১ ডলার। তিনি নিজেকে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে গণ্য করে মাসে ১ ডলার মাসোহারা নিতে সম্মত হন। তাঁর এক ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন সেটা হুবহু তুলে দিচ্ছি। অনুবাদ করলে এর ওজস্বিতা ভেঙ্গে যাবে।




আমরা খেয়াল করবো কাদের উনি ধন্যবাদ দিলেন। কোন নেতা বা বীরকে নয়, যারা প্রতিদিন জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন সেসব অনামা, ইতিহাসের প্রান্তবাসীদের। বেথুন আগুন জ্বালিয়ে দিলেন আমার শরীরের সমস্ত কোষে। একদিকে মেধাবী ছাত্র হিসেবে আমার গবেষণার আকাঙ্খা, আরেকদিকে মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে সামিল হবার সুতীব্র আবেগ – এ দুয়ের মেলবন্ধন ঘটালেন তিনি।
সেরকম সময়ে খোলা চোখে দেখতে পেলাম, চোখের সামনেই দৃশ্যমান হল, যে দাদাদের একটি অবিভাজ্য সত্তা হিসেবে মনে করতাম তারা আসলে অনেকগুলো সত্তা। তাদের অনেক রাজনৈতিক বিভাজন। কেউ চারু মজুমদারকে নাকচ করছে সরাসরি, দায়ী করছে সত্তরের দশকের সমস্ত বিপর্যয়ের একমাত্র evil spirit হিসেবে। কেউ চারু-লিন পিয়াও পন্থী, কেঊ চারু-লিন বিরোধী অবস্থানে। কেউ মাঝামাঝি এক রাস্তায় হাঁটছে, কেউ কেবলমাত্র গণআন্দোলনের কথা বলছে। কেউ বলছে গ্রামে চলো, কারো মুখে ডাক্তারি শিখে বৈপ্লবিক চিকিৎসাব্যবস্থার কথা। কিন্তু সত্তরের দশকের জ্বলন্ত (গলন্তও বটে) প্রশ্নগুলোর সরাসরি কোন উত্তর পাচ্ছিনা। অনীক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত চিন চিং মাই-এর উপন্যাস (যৌথ উপন্যাসও) “বিপ্লবের গান” অন্তরের জ্বালামুখ খুলে দিচ্ছে। কোথায় যাবো আমি? আমি কে? কিভাবে যাপিত হবে আমার জীবন? মেধার একটুখানি গুমোর বুঝি সবারই থাকে। আমিও কোন ব্যতিক্রম ছিলামনা। গোগ্রাসে মার্ক্সবাদের বুনিয়াদি বই বলে যেগুলো প্রচলিত ছিলো – সে মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও, এমনকি রোজা লুক্সেমবার্গ, হোচি মিন, চে গুয়েভারা অব্দি – সবই আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছি। চার খণ্ডে প্রকাশিত “মার্ক্সবাদী সাহিত্য বিতর্ক” পড়ছি, পড়ছি আন্তর্জাতিক “মহা বিতর্ক” বা great polemics-এর দলিলগুলো। পড়ছি সুপ্রকাশ রায়-এর “ভারতের কৃষক সংগ্রাম এবং গনতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস”। কি বিপুল শ্রম এবং যত্ন নিয়ে একটি পুস্তকের জন্ম হতে পারে প্রত্যক্ষ করলাম এ বই-এ। এর সাথে আরো দুটি আশ্চর্য বই পড়লাম – স্পেনের গৃহযুদ্ধের নেত্রী ডলোরেস ইবারুরির (Dolores Ibarruri) লেখা অদম্য প্রতিরোধ সংগ্রামের কাহিনী “লা পাসনারিয়া” (La Pasionaria – No passer on), বাংলায় যার অর্থ করা যায় আর এগিও না! পিঠোপিঠি পড়লাম ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মারিয়া-আন্তোনিয়েত্তা মাকিওচ্চির লেখা “Daily Life in Revolutionary China” – কিভাবে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে শিশুরা লেখাপড়া শিখছে চীনের স্কুলে, কিভাবে পড়াচ্ছেন ওখানকার শিক্ষক-শিক্ষিকারা নতুন নতুন তত্ত্বভুবন খুলে যাচ্ছে চোখের সামনে। (বলার কথা, পরবর্তী সময়ে বহুপঠিত এবং ততোধিক চর্চিত গ্রামশি-র নামও শুনিনি আমি সেসময়ে এখন ভাবলে একটু অবাক লাগে!) আরেকটি অন্য ধরণের বই অজানা তাত্ত্বিক-ব্যবহারিক প্রসঙ্গগুলোকে ভাবিয়ে তুললো – জেরম চেন-এর “Mao Papers”
এ সময়ে লুকিয়ে চুরিয়ে হাতে এলো চারু মজুমদারের রচনাসংগ্রহ। দেখলাম কি অসামান্য ধীশক্তি দিয়ে তাত্ত্বিকভাবে আপাতদুরূহ ও জটিল সব প্রশ্নের এবং জিজ্ঞাসার সাবলীল, স্পষ্ট এবং লক্ষ্যভেদী উত্তর দিচ্ছেন। ভারতের কৃষক আন্দোলনের এতদিনের সঞ্চিত ব্যথা, যন্ত্রণা, অপ্রাপ্তি-কে মনে হল চারু মজুমদার নিজের সত্তায় ধারণ করেছেন। যেন প্রথমবারের মতো মন্ত্রোচ্চারণ শুনলাম - শিশুদেরও শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। এতদিন যা ভাসাভাসা অস্পষ্ট অবয়বহীন এক চেহারায় ছিল তা অবয়ব পেতে শুরু করলো – এই শক্তিশালী ভারতরাষ্ট্রের সাথে সরাসরি সশস্ত্র মোকাবিলা করতে হবে কৃষকদের ওপরে নির্ভর করে। মধ্যবিত্ত সমাজ, কেতাবী শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক-যুবতী এবং শ্রমিক সমাজ (শ্রেণী শব্দটি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম না) কৃষক আন্দোলনের সহকারী শক্তি হিসেবে কাজ করবে। শহরে ও গ্রামে ছোট ছোট গেরিলা স্কোয়াড, আচমকা আক্রমণ করে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে “বিপ্লবী বাহিনী”-কে সজ্জিত ও শক্তিশালী করা – এ ধারণাগুলো আমাদের মতো টগবগে নতুন যুবকদের কাছে সুস্পষ্ট এক চেহারা নিয়ে এল বিপ্লবী কার্যক্রম সম্পর্কে। নিজের অভ্যন্তরে শুরু হল এক নতুন ধরণের দোলাচলচিত্ততা – একজন ভালো ডাক্তার না বিপ্লবীকর্মী, কে অগ্রাধিকার পাবে আমার  জীবনের আগামী অজানা নতুন যাত্রাপথে, এই নতুন যাত্রাবিন্দুতে এসে?
শুভাশিসের সাথে তোমার নতুন যাত্রাপথ শুরু হল সরাসরি আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি সংগঠন  দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি বা 2nd CC-র সাথে যুক্ত হয়ে। দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি কথাটির বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। চারু মজুমদারের জীবদ্দশায় ১৯৭০ সালে প্রথম পার্টি কংগ্রেস হয়েছিল সিপিআই (এমএল) সংগঠনের। ১৯৭২ সালের ২৮শে জুলাই চারু মজুমদার লালবাজার লক আপে শহীদ হবার পরে এবং চীনে ১৯৭৩-এ কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না-র ১০ম কংগ্রেসের পরে রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন ছোট-বড়ো প্রশ্ন উঠে এল। তার একটি হল, আমাদের কলেজে যেমন দেখেছিলাম, চারু মজুমদার ও লিন পিয়াও-এর পক্ষে বা পক্ষে নয় কারা বা কোন সংগঠন। উল্লেখযোগ্য, কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না-র ৯ম কংগ্রেসে লিন পিয়াও-কে মাও সে-তুং-এর “যোগ্য উত্তরসূরী” ঘোষণা করা হয়। সেসময়ে চারু মজুমদার ও লিন পিয়াও-এর পক্ষে রাজনৈতিক অবস্থান ঘোষণা করে উত্তরবঙ্গে কাজ করছিল শান্তি পালের নেতৃত্বে সংগঠন। চারু মজুমদারের ঐতিহাসিক আটটি দলিল যে কমরেডরা নক্সালবাড়ি অঞ্চলে কৃষকদের মাঝে প্রথম নিয়ে গিয়ে লেগে পড়ে থেকে কৃষক অভ্যুত্থানকে সম্ভব ও সফল করে তুলেছিলেন শান্তি পাল তাদের একজন। একই অবস্থানে দক্ষিণবঙ্গে কাজ করছিলেন মহাদেব মুখার্জী ও তার নেতৃত্বে সংগঠন। মহাদেব মুখার্জীর নেতৃত্বে ১৯৭৩-এ হুগলি-বর্ধমান সীমান্ত অঞ্চলে কামালপুর গ্রামে সিপিআই (এমএল)-এর দ্বিতীয় কংগ্রেস হয়। এরপরে ১০ জন পুলিস কর্মী খতম হয়, প্রায় ৪০টি বন্দুক ছিনতাই-এর ঘটনা ঘটে দক্ষিণবঙ্গে। ১৯৭৮-এ মহাদেব মুখার্জীর সংগঠন থেকে বেরিয়ে এলেন আজিজুল হক এবং অধ্যাপক নিশীথ ভট্টাচার্য, আবার শান্তি পালের সংগঠন থেকে বেরিয়ে এলেন সুবীর তালুকদার, অনিল বরণ রায় প্রমুখেরা। এদেরকে নিয়ে নতুন করে গড়ে উঠলো সিপিআই (এমএল) দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি বা সেকেন্ড সেন্ট্রাল কমিটি, সংক্ষেপে সেকেন্ড সিসি (2nd CC)
জয়ন্ত, তুমি যখন রায়গঞ্জের স্কুলে পড়তে সেসময়ে স্কুলের দেয়ালে আলকাতরা দিয়ে লেখা দেখেছিলে – “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান / চীনের পথ আমাদের পথ”। দেখেছিলে – “বিপ্লব জনতার উৎসব”। দেখেছিলে – “বিপ্লব কোন সূচিশিল্প নয়” এবং আরো কতো কতো লেখা যেগুলো কিরকম এক শিহরণ জাগাতো সমস্ত সত্তা জুড়ে। কলকাতার দেয়ালেও দেখলে সেসব শ্লোগান – কোথাও আলকাতরা দিয়ে, কোথাও লাল রঙ দিয়ে।
একদিকে জরুরী অবস্থা আছে বলে মানুষ ফিসফিস করে কথা বলে, আবার সমস্ত কিছুকে ফাটিয়ে – সুভাষ মুখার্জীর কবিতার পাঁজর ফাটিয়ে কচি কচি পাতার হাসার মতো – দেয়াল লিখন রয়েছে “হাত দিয়ে বলো সূর্যের আলো রুধিতে পারে কি কেউ”। তখন বারেবারে তোমার মনে পড়ছিলো – এ কলকাতার মাঝে আছে আরেকটা কলকাতা / হেঁটে দেখতে শিখুন / হেঁটে দেখতে শিখুন ঝরছে কি খুন দিনের রাতের মাথায় / আরেকটা কলকাতায় সাহেব আরেকটা কলকাতায়।
প্রশ্ন এলো আমরা কোন কলকাতায় অন্তরিন? পরে যখন ছাত্র রাজনীতির সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েছ তুমি তখন বস্তির মাঝে, নোংরা ড্রেনের পাশে ঝুপরির মাঝে যেসব মানবসন্তানের মতো দেখতে (হয়তো বা পূর্ণ মানব নয়) প্রাণীদের চিকিৎসা করা শুরু করেছিলে তখন আবার ফিরে দেখতে চাইলে টেক্সট বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হিসেবে হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক বা অ্যালঝাইমার’স শেখা আর “tropical neglected disease” শেখার মাঝে সমন্বয় সাধন হবে কিভাবে? একজন চিকিৎসক কি তার সিলেবাসের, পারিপার্শ্বিকের লোভনীয় হাতছানির ঊর্ণজালে অন্তরিন হয়ে পড়ছে? মনে পড়ে, বড়ো তীব্রভাবে মনে পড়ে, তোমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ও কমরেড শুভাশিসের কথা। শুভাশিস নরেন্দ্রপুরে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে পড়তো, উজ্জ্বল ছাত্র। ও তো সাঁতার না জেনে তিন বছরের মধ্যে গ্রামজীবনের পাঠ নিতে গিয়ে জলঙ্গীর জলে হারিয়েই গেলো। জানিয়ে দিল আর কখনো দেখা করার জন্য, একসাথে পথচলার জন্য আর কখনো ফিরে আসবেনা।
শুভাশিস তুই আবার ফিরে এসেছিলি শক্তিনগরের মাটিতে, শহীদ রমেন সাহার নেতৃত্বে। এলাকার “রবিন হুড” বলে একসময়ে পরিচিত রমেন সাহা পার্টিতে যোগ দিয়ে পরিপূর্ণ রূপান্তরিত এক নতুন মানুষ সত্তা হয়ে ওঠেওর নেতৃত্বে ও বীরত্বে শক্তিনগর দুষ্কৃতি মুক্ত হয়, নির্ভয়ে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সবাই চলাফেরা করতে শুরু। হাসপাতালে চিকিৎসার চেহারা এবং চরিত্র বদলে যায়। আর তোর নামে গড়ে ওঠে শহীদ উদ্যান। তুই আমার হাত আর কখনো না ধরলেও বেঁচে রইলি এই স্মৃতির মাঝে। এসময় দিয়েই ভাঙ্গরে রাইফেল ছিনতাই-এর ঘটনা ঘটে। তোর শহীদ হওয়া এর একটা নেপথ্য প্রেরণা ছিলো।
এবার একটু পেছনে ফিরি। আগু-পেছু করেই তো আমাদের বেঁচে থাকা।
আমরা তো আমাদের আত্ম তথা self-কে খুঁজে চলেছিলাম কোথায় আমাদের আত্ম? মেডিক্যাল কলেজে মাস মাইনে তখন ২০ টাকারও কম। আমরা হিসেব করে দেখেছিলাম আমাদের পড়াশুনো শেষ করতে ১,০০,০০০ টাকারও বেশি খরচ পড়ে। কে দেয় এ টাকা? তখনো “দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন”-এর মতো সত্তরের দেয়াল-লেখাগুলো আমাদের অন্তত একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে – কে দেয় আমাদের ডাক্তারি পড়ার খরচ? যে অগণন সহায়হীন ভারতবাসী তাদের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে আমাদের পড়ার ভর্তুকি দেয় তাদেরকে আমরা কি ফিরিয়ে দেব? আমাদের আত্মতো এক অর্থে অন্তরিন হয়ে আছে এত এত মানুষের ঋণে। জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে উঠে আসছিল – এ অন্তরিন আত্মকে নিজেরাই স্পর্শ করতে পারছি তো? জিজ্ঞাসা চিহ্নগুলো হানা দিয়েছে বারেবার। আমার আর শুভাশিসের হাত ধরা আরো নিবিড় হয়েছে, শক্ত হয়েছে। “দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন”-এর সেই লাইনটি বারেবারে হানা দিয়েছে – Old Russia was rapidly breaking up (খুব দ্রুত ভেঙ্গে পড়ছিল পুরনো রাশিয়া)। মেডিক্যাল কলেজে ঢোকার ৫-৭ বছর আগে এরকমইতো দ্রুত ভেঙ্গে পড়ছিল পুরনো ভারত। আকাশ বাতাস জুড়ে ছিল – “শেকল ছেঁড়ো বন্ধু, শেকল ছেঁড়ো / শেকল ছেঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাঙ্গ হবে তোমার দুঃসহ দুঃখের দারুণ দুর্দিন”। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস বা অমোঘ নিয়মে রাষ্ট্র আবার ভেঙ্গে পড়া ব্যবস্থাকে সারাই করে নিয়েছিল, সমাজে রয়ে গিয়েছিল তার স্মৃতি। স্মৃতির রক্তাক্ত, নীরবে বয়ে চলা ইতিহাস জনসমাজ তখনো বহন করে চলেছে। মধ্যবিত্ত জীবনে রয়ে গেছে গভীর ক্ষত, শোনিতের গন্ধ, বারুদের ঝলকে ওঠার চলচ্ছবি, রাষ্ট্রের প্রহরীদের – ঊর্দি পরে বা না পরে – হাতে অসংখ্য মানবসন্তানের লাশ নিখোঁজ হয়ে যাবার আর গায়েব হয়ে যাবার টাটকা স্মৃতি। শঙ্খ ঘোষের যন্ত্রণাদীর্ণ ছড়ার লাইন ঘুরে বেড়াচ্ছে মুখে মুখে – “পেটের কাছে উঁচিয়ে আছো ছুরি / কাজেই এখন স্বাধীনমতো ঘুরি …. এখন সবই শান্ত এবং ভালো”। এরকম মধ্যবিত্ত সমাজে – শহরে এবং শহরতলিতে, গ্রামীন শহরে এবং গ্রামে – প্রবেশ করেছিলাম আমরা। কিছু দ্বিধা সংশয় প্রাথমিকভাবে থাকা সত্ত্বেও মানুষ দাওয়ায় মাদুর পেতে দিয়েছে, ঘরে ডেকে নিয়ে ছিন্ন শয্যায় শুতে দিয়েছে, নিজের মুখের অন্ন বা সামান্য সংগতি ভাগ করে নিয়েছে আমাদের সাথে। জীবনের এক নতুন চলার পথ শুরু হয়েছিল। পড়ে আসা জ্যামিতির ভাষায় নতুন স্থানাংক, নতুন locus তৈরি হল।
পড়ার পাট চুকিয়ে আমাদের (আমার আর শুভাশিস দুজনরেই) যাত্রা শুরু হল আমাদের আত্মকে খুঁজতে ভারতের জীবনপ্রবাহের কেন্দ্রে – গ্রামাঞ্চলে। চোখে এক আকাশ তারার সম্মিলিত তারকাপুঞ্জের উজ্জ্বলতা, বুকে বিপুলা সমুদ্রের অন্তহীন কলোচ্ছ্বাস, সমস্ত সত্তা জুড়ে খেলে চলেছে “জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম”। সাথে কাঁধের ব্যাগে চারু মজুমদারের রচনা সংগ্রহ, দু-একটি জামাকাপড় আর বিখ্যাত “রেডবুক”। আমাদের এ যাত্রা রবীন্দ্রনাথের “গোরা”-র ভারতাত্মাকে খোঁজা ছিলোনা। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম গ্রামভিত্তিক সংগঠন, সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধ আর আমাদের ক্রম-সঞ্চিত উদ্যোগের মধ্য দিয়ে জায়মান এক বিপুল গণঅভ্যুত্থানে। চারু মজুমদারের পাঠ এবং নেতৃত্বের বিভিন্ন আলোচনার নির্যাস হিসেবে বুঝতে শুরু করেছিলাম কেবলমাত্র ছোট ছোট গেরিলা স্কোয়াড তৈরি করে গ্রামের কৃষকদের দ্বারা চিহ্নিত জোতদার খতম আর সুযোগ বুঝে পুলিসের রাইফেল লুঠ করে গেরিলা মুক্তাঞ্চল তৈরি করা সম্ভব। সেখানে বিপ্লবী সরকারের শাসনাধীন থাকবে নিয়ম-কানুন, এমনকি নিজেদের কারেন্সি নোটও ছাপা হবে। এবং আরো আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় জোর করে গড়ে উঠলো (এই অর্থে যে ক্যাডার এবং সাধারণ মানুষের সাথে কোনরকম আলোচনা ছাড়া) “উত্তরবঙ্গ-বিহার-আসাম” শিরোনামে আমাদের স্ব-ঘোষিত বিপ্লবী সরকার। তার অন্তত একটি সফল আবশ্যিক কর্মসূচী ছিল – প্রতি ২৮শে জুলাই চারু মজুমদারের শহীদ দিবসে উত্তরবঙ্গব্যাপী বনধ ডাকা। সে বনধ সাংগঠনিকভাবে ডাকা না-ডাকা নিরপেক্ষভাবেই ২৫ বছরের (১৯৮১ সাল থেকে) বেশী সময় ধরে স্বতস্ফূর্তভাবে সফল হয়েছে। ভয়, অজানা আতঙ্ক আবার সমীহ আর শ্রদ্ধা সবই মিশে ছিল এর মাঝে। মালদা দিনাজপুরের গ্রামের পরিবেশে ইটাহার-বামুনগোলা-হবিবপুর-গাজোল এই ৪টি থানার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অন্তত ৬ মাস ধরে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যখন দিনের বেলাতেও আমরা গ্রামে ঘোরাঘুরি করতে পারতাম। দু-এক ঘর “শ্রেণী শত্রু”-র বাড়ি বাদ দিয়ে যেকোন বাড়িতে যেকোন সময়ে যতজন খুশী গিয়ে উঠতে পারতাম। পাশের বাড়ির বা পাড়ার অন্যান্য কমরেডরা এগিয়ে আসতো আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। জোতদারের জমির ধান কৃষক কেটে নিয়ে গেছে, পুকুরের মাছ তুলে নিয়ে গেছে।
এক বৃদ্ধ কৃষকের পাশে বসে তেভাগা আন্দোলনের সময়ে গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে জনজোয়ারের কাহিনীমালা শুনেছি। অতি যত্নে মাটির ঘরের কুলুঙ্গিতে রাখা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য কার্ড দেখিয়েছেন – জীবনের পরম সঞ্চিত ধন। মনে পড়ে তোমার – শহরের এক বাড়িতে গিয়ে রাত্রিবেলা হঠাৎ করে ভীষণ জ্বর এলো তোমার এবং ঘোরের মধ্যে বমি করে সমস্ত বিছানা, জামাকাপড় ভাসিয়ে দিয়েছিলে? সেদিন, সে রাতেই সবকিছু পরিষ্কার করে ফেলেছিলো তোমার বন্ধুর ভাই। তোমাকে কি চোখে দেখতো এখন অনুমান করা যায়। পরে ও হোলটাইমার হল, জেলে গেলো। জেল থেকে বেরলো।
আমরা মুক্তাঞ্চলের স্বাদ পেতে, বুঝতে শুরু করেছিলাম। শুরু করেছিলাম আমাদের শক্তিকে আতসকাচের নীচে না ফেলে, মাও সে তুং-এর হুনান রিপোর্টের পরোয়া না করে, লেনিনের বিভিন্ন প্রাক-বিপ্লব এবং বিপ্লবোত্তর বিচার-বিশ্লেষণকে ধর্তব্যের মধ্যে না এনে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে লেখা চারু মজুমদারের লেখাগুলোই সমস্ত কিছু বিচারের একমাত্র উপজীব্য হয়ে উঠলো আমাদের কলেজ ছাড়ার সময়ে যে “বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই”-এর মতো কাড়িকাড়ি বই-এর কথা লিখেছিলাম সে “অতুল প্রতিভাধর” ছেলেটি কি করলো সেসময়ে? প্রায় কিছুই করেনি। ঐ প্রবল রাজনৈতিক স্রোতে ভেসে গেছে, বিপ্লবী আবেগের দাবানলে পুড়ে গেছে খাঁটি সোনা না হয়েই।
এটা সমগ্র সংগঠনের সামগ্রিক সিদ্ধান্ত ছিল, আলাদা করে কাউকে খুঁজে পাওয়া, কারো দিকে আঙ্গুল তোলা যাবেনা। এটা অন্যায় হবে। এটাও একটা খবর যে আমাদের “বিপ্লবী স্পর্ধা” হিতাহিত-রহিত হয়ে এমন একটা উত্তুঙ্গ অবস্থায় পৌঁছেছিল যে আমরা আমাদের সামর্থ্য, maneuvering space, বাংলার মাটিতে আমাদের বাস্তব ভিত্তি এসমস্ত কিছুর তোয়াক্কা না করে সেসময়ের পশ্চিমবাংলার বিধানসভার বিরোধী দলনেতা কাশীকান্ত মৈত্রকে “কিডন্যাপ” করেছিলাম আমরা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য। এ যেন চীনের ভারতীয় সংস্করণ, বাস্তব অবস্থা যাই থাকুকনা কেন! এর পরিণতিতে কাশীকান্ত মৈত্রকে আমাদের কদিনের মধ্যেই ছেড়ে দিতে হল। আমাদের একের পর এক শেল্টার রেইডেড হল, কাড়িকাড়ি টাকা ধ্বংস হল। ১৯৮২-র মাঝামাঝি থেকে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে মতপার্থক্যের চোরাস্রোত বইতে শুরু করলো। টের পেতে শুরু করলাম অন্যরকম আবহাওয়া তৈরি হয়েছে পার্টিতে। আমারও পদোন্নতি হল। আমি একটি বড়ো আঞ্চলিক কমিটির সেক্রেটারি হলাম। তারপরে রাজ্য কমিটিতে, আরো পরে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবিত সদস্য। কিন্তু পার্টির গঠনগত বৈশিষ্ট্যের জন্য কিংবা আমাদের গ্রামীন সমাজের তথা শহরেরও সামাজিক মানসিকতা (social psyche)-র নিজস্ব বিশিষ্ট চরিত্রের জন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই বলার যোগ্য কোন দ্বিমত বা তথাকথিত দু লাইনের সংগ্রাম হয়নি। আমাদের social psyche-তে প্রশ্নহীন আনুগত্য ও কাজের একটা বোধ মনে হয় সবসময়েই কমবেশী কাজ করে। তখনো এটা ঘটেছিল। একেবারে শেষ মুহূর্তে বিশেষ করে জীবনচর্যার পরিবর্তনের মতো মোটাদাগের বিষয়গুলো যখন সামনে আসে তখনই কেবল দ্বিধা ও বিরোধিতা সাকার চেহারা নেয়।
১৯৮১ সালের ২১-২২শে ফেব্রুয়ারী দু রাত জুড়ে ইটাহার আর বামুনগোলা থানায় ধনী কৃষক আর জোতদারদের ঘর থেকে ৬২টিরও বেশী বন্দুক লুঠ করা হল। তারও আগে বিহারের দু-চারটে গ্রাম জুড়ে সংগঠন আছে এমন এলাকায় পুলিস ফাঁড়ি থেকে রাইফেল লুঠ করতে গিয়ে দুজন গুরুত্বপূর্ণ কমরেড শহীদ হল, একজন বাদে সবাই ধরা পড়লো। ইটাহারের বন্দুক লুঠ এক ভয়ংকর বিপর্যয় “আহ্বান” করে আনলো সংগঠনের জীবনে। শুরু হল চিরুনিতল্লাশী। আধাসামরিক বাহিনী এ এফ আর এবং সি আর পি স্থানীয় থানার সাহায্য নিয়ে আমাদের ইঁদুরের মতো কোণঠাসা করে ফেললো, আমরা এলাকা ছাড়া হলাম। অরক্ষিত পড়ে রইলো স্থানীয় মানুষ। প্রশ্ন উঠতে শুরু করলো আমার মনে, হয়তো আরো বেশ কিছু সহযোদ্ধার মনে। একাধিক সহযোদ্ধা পার্টিকে না জানিয়ে নিজেদের মতো করে চলে গেল। পরে, আমার মতোই, আবার মূলস্রোতে ফিরে গেছে।
আজ পেছন ফিরে দেখে মনে হয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের বোধে কখনো আসেনি (আমার বিশ্বাস সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সহ) আমাদের স্বপ্নের “বিপুল অভ্যুত্থানের” চেয়েও বিপুল রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটির ক্রিয়াশীলতা, এর maneuvering power and technique, মানুষের মাঝেই বাস করে একটা-দুটো-তিনটে মানুষ এই উপলব্ধি। এতদিন বাদে এসে, ইতিহাসে যাকে টেলিস্কোপিক দেখা বলে, মনে হয় বিপ্লবী আবহাওয়ার ঝাঁঝে, নিজেদেরকে সুরক্ষিত আর শক্তিশালী রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী সমভূমিতে স্থাপন করার সুতীব্র তিয়াসা ও আরো কিছু সমসাময়িক বিষয় আমাদেরকে এরকম কোন বিপ্রতীপ উপলব্ধিতে পৌঁছনো থেকে দূরে রাখছিলো, এমনকি নেতৃত্বকেও। যদিও আমি নিজেই নবীন নেতৃত্ব হিসেবে ছিলাম।
তখন শব্দ শুষে নিচ্ছিল চিন্তাকে। কিছু শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে বিপ্লবের অন্তর্ভাষা, প্রকাশের ব্যাপ্তি, এমনকি মানুষের বিপ্লবী মনের ভাষাও এ বিশ্বাস আমাদের প্রকান্ড থেকে প্রকান্ডতর হচ্ছিল আর ক্রমাগত ছেয়ে ফেলছিলো আমাদের বৌদ্ধিক জগৎ, মননের শক্তি, চিন্তন ক্ষমতা। চিন্তার সবুজ, সজীব ধারা শুকিয়ে যেতে শুরু করলো। নেতৃত্বের জন্য প্রশ্নহীন আনুগত্য তার জায়গা নিলো। “রেডগার্ড স্কোয়াড” বলে কিছু শহরে যে কিশোর-যুব-ছাত্র-ছাত্রী বাহিনী তৈরি হল তারা স্বপ্ন দেখেছিলো রাশিয়া বা চীনের মতো শহর জুড়ে জন্ম নেবে বিপ্লবী বাহিনীর দল। যাত্রা করবে গ্রামেগ্রাম আর শহরের অভ্যুত্থান জুড়ে যাবে – মেকং, গঙ্গা, ভোল্গা, ইয়াং সি কিয়াং-এর মতো। হয়তো বা ইতিহাসের পরিহাস হিসেবে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার পরিবর্তে শহর থেকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী গিয়ে গ্রাম ঘিরে ফেলতে শুরু করলো। আর আমরা গ্রামে ক্রমাগত শেল্টার পালটে পালটে থাকতে শুরু করলাম। যখন সেটাও হলনা তখন শহরে এসে উঠলাম, আমাদের চারপাশের বলয়ে রইলো সশস্ত্র বাহিনী। রাষ্ট্রের তরফে “শহর দিয়ে গ্রাম ঘেরা”-ই বরঞ্চ সফল হল। আমরা আরেকবার অন্তরিন হলাম – নিজভূমে পরবাসীর মতো। আজ বিশ্বাস করি নালকের মতো নিষ্পাপ সেই যুববাহিনী এমনকি অন্যায়ভাবে লেভিও তুলেছে শহরে। এরকম এক মুহূর্তে আমার রাজনৈতিক বোধ এবং বিচার আমার মাঝে বিদ্রোহের তাগিদ চাগিয়ে দিলো। আরেকটা কষ্টকর কথাও এখন অকপটে বলার সময় এসেছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কয়েকজন “কৃষক চেতনা” এবং “শ্রেণী একাত্মতার” প্রবল তাগিদের অনুপান হিসেবে যেকোন শেল্টারে বা অন্য জায়গায় মদ্যপানকে স্বাভাবিকতার স্তরে নিয়ে এলো। এ বিলাসিতার যোগান হচ্ছিল শহরের বিশ্বস্ত বন্ধুদের লেভি বা  গ্রামে খেয়ে না-খেয়ে পড়ে থাকা কমরেডদের সংগৃহীত অর্থ থেকে। আমি আর মানতে পারছিলাম না। মতপার্থক্য শুরু হতে থাকলো। কিন্তু সুশীতল রায়চৌধুরীর মতো এ কোন দু-লাইনের সংগ্রাম ছিলনা।  আমার সে যোগ্যতাই ছিলনা। ততদিনে আমি আমার ভেতরে ভেতরে ভাঙ্গতে শুরু করেছি। পুরনো প্রশ্ন উঠে উঠে আসছে – বেথুনের মতো চিকিৎসক-বিপ্লবী কিংবা আমার অধীত বিদ্যা বিসর্জন দিয়ে শুধুই একজন বিপ্লবীকর্মী? হোল টাইমার হবার সময় ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি থেকে তিন-চারটে ডাক্তারির একেবারে গোড়ার শিক্ষার বই “চুরি” করেছিলাম। সেগুলো কাজে লেগেছিল যখন “অ্যাকশন”-এ গিয়ে এক কমরেডের হাতে গভীরভাবে তীর বিঁধলে তার সফল চিকিৎসা করতে পেরেছিলাম।
এখন ভেবে দেখি আমিতো পরভূমে নিজবাসীও ছিলাম, ছিল আমার মতো আরো অনেকেই। ভুলি কি করে সে সকালের কথা যখন যে ভূমিহীন রাজবংশী কৃষক পরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলাম সে বাড়ির চারপাশে ঘিরে ফেলেছে আধাসামরিক বাহিনী, সেই ৬০-এর বেশী বন্দুক দখলের ঘটনার পরে কৃষক বাড়ির ভারী মিষ্টি অল্পবয়সী বৌটি আমাকে মামা বলে ডাকতো, আমি নাকি ওর মামার মতো দেখতে। ও আমাকে ঘরের ভেতরে রেখে এক মস্ত বড়ো হাঁসুয়া নিয়ে মাটির দেওয়ালের দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আগে ও একজনের মাথা নামাবে তারপরে আমাকে ধরতে দেবে। অবশ্য তার আর দরকার পড়েনি। আধাসামরিক বাহিনীর মুহূর্তের অসতর্কতার সুযোগে প্রথমে আমরা তিনজন গড়িয়ে পাশের পুকুরের ঝোপে চলে এলাম। পরে চিরুনিতল্লাসী শেষ হলে কোনরকমে এলাকা ছাড়া হলাম। আর আমাদের আশ্রয়দাত্রী সেই “ভাগ্নী”? আর কখনো দেখা হয়নি। ৪০ বছরের ব্যবধানে মুখটাও স্পষ্ট মনে পড়েনা। আমি চলে এলাম। আবার ডাক্তারিতে ভর্তি হলাম। ও কোথায় গেল, কিভাবে রইলো কিছুই জানিনা। গ্রামের, শহরের কত মানুষ তাদের অনেকের নাম আর এখন মনেও পড়েনা আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। বুক দিয়ে আগলে রেখেছে একই বিশ্বাসের সওয়ার হয়ে – এ সমাজ বদলাবে। কিন্তু তাদের কোন দায়িত্ব আমরা নিতে পারিনি। হয়তো তারা প্রত্যাশাও করেনি। কিন্তু আমার বোধের কাছে, বিবেক নামক অনুভব-নির্ভর বস্তুটির কাছে কোন জবাব দিতে পারিনি। এখনো নয়। এদেরকে নিয়ে আধুনিক বিদ্যাচর্চার জগতে পোস্টকলোনিয়াল, সাব-অল্টার্ন ও আরও কতো কতো জ্ঞানচর্চার ধারা বিকশিত হয়ে চলেছে। কিন্তু বাস্তব praxis-এর অচলায়তনে এরা তো subject-ও নয়, agency-ও নয়। শুদ্ধমাত্র পেটের ভাত আর নিজেদের টিঁকে থাকবার অস্তিত্বকে বাঁচানোর জন্য রাজনৈতিক বর্ণ বদলে যায় এদের। সেসময়ে এদের নিজেদের স্ব-গত সত্তাও অনেকটা বদলে যায় বৈ কি।
আমরা ভেঙ্গে যাচ্ছিলাম – সংগঠনে, মানব শক্তিতে। যারা মেলাতে পারছিলো না বসে যাচ্ছিল। নতুন মুখ কিছু যুক্ত হচ্ছিল। কিন্তু ডিমান্ড-সাপ্লাই-এর নিয়মে সরবরাহতে ঘাটতি পড়ছিল। শুরু হয়েছিলো সাংগঠনিক রক্তক্ষরণ।
অজ্ঞাতবাস পর্ব একদিন ঘুচলো। শহরের এক শেল্টার থেকে পুলিসের খাতায় “মোস্ট ওয়ান্টেড” আমি ধরা পড়লাম। পুলিসি পর্ব এবং আনুষঙ্গিক কার্যকলাপ সারার পরে চালান করা হল কারাগারে। যখন জেলে ঢুকছি তখনো কষের রক্ত শুকিয়ে যায়নি, ভ্রুর ওপরে চাপ বেঁধে রয়েছে রক্ত। কিন্তু সেলে পৌঁছতেই দেখা পেলাম যারা আগে ধরা পড়েছে সেরকম এক সহযোদ্ধার (জেল থেকে বেরিয়ে অনেক বছর পরে টিবি-তে ভুগে ও মারা গেছে)অন্তর থেকে খুশির বুদবুদ ওপরে ভেসে উঠতে শুরু করলো। সেলের ভেতরে একটা দুর্গন্ধমাখা কম্বল, তার মধ্যে যে কি আছে আর কি নেই ঠাহর করা মুশকিল বিভিন্ন দরিদ্র শেল্টারে এতদিন থাকলেও এরকম অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। বুঝলাম এ এক নতুন অন্তরিন অবস্থা। এখানে আমার ইচ্ছে কোন বার্তা বহন করেনা। আধুনিক পরিভাষায় এখানে আমি কোন subject বা agency বা কর্তা নই। কোন কিছুর নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই, আমার বোধের ওপরে নির্ভর করেনা কোনকিছু এখানে আমি কেবলমাত্র একটি object অর্থাৎ বিষয়। এবং অবজেক্ট হিসেবেই আমার অবস্থান নির্দিষ্ট হয়ে আছে এখানে। এখানে আমার আত্ম (self) গলে যাচ্ছে, ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে (তখন দালির ছবির কথা মনে পড়েছে) জন্ম নিচ্ছে নিজের ওপরে বিশ্বাস হারানো এক মানুষ। জেল ব্যবস্থার গোড়া থেকেই এজন্যই তো জেলকে তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ফুকোর লেখায় আমরা অতি চমৎকার বিশ্লেষণ পেয়েছি জেলব্যবস্থার ওপরে তখন অবশ্য ফুকোর কোন লেখা আমি পড়িনি। শুধু “প্যান অপটিকন” শব্দটির খবর জানতাম। অবশ্য ধ্রুপদী বিদ্যাচর্চার বাইরে “স্মার্ট” বিদ্যাচর্চা তখনো করায়ত্ত হয়নি আমার। একথাগুলো না হয় থাক এখন।
আমার অতি কাছের সে সহযোদ্ধাকে দেখলাম নিজের পুনর্নিমিত সত্তা নিয়ে বেশ আছে। অপ্রয়োজনে দাঁত বের করে জেলরক্ষীদের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে খাচ্ছে, তাস খেলছে, মুখের ভাষা বদলে গেছে, বদলে গেছে অভিব্যক্তির ভাষা। কাকে দেখেছিলাম আমি সেদিন? এ মানবসন্তানের সাথে আমার হোলটাইমার জীবনে পরিচয় ছিলনা। আমার প্রিয় সহযোদ্ধার আমার অচেনা এ এক নতুন সত্তা – গোর্কির পাভেলের বিপরীতে থেকে গেলো, অনেকটা অনায়াসেই হয়তো বা। অনায়াস-পরিবর্তনের চোরাস্রোত আমাদের জীবনপ্রবাহও বুঝি!
আমার মনে তখন দিশাহীন প্রশ্ন ঘুরছে – কি করবো আমি? জানিনা ছাড়া পাবো কিনা। পেলে কবে পাবো তাও জানিনা। পুলিসি “আদরে” আমি ভেঙ্গে পড়েছিলাম। রক্তের অন্তর্গত কবিতার প্রবাহ থাকলেও দ্রোণাচার্য ঘোষ হতে পারিনি। এখন মনে হয় চেষ্টাও করিনি। অনেক পলকা ধাতুতে তৈরি হয়েছিল আমার শরীরী ওজস্বিতা মনে হয়, ওদের মৃত্যু, ছিন্ন শির তিমিরের স্মৃতি যতো যন্ত্রণার জন্ম দিয়েছে ততো প্রতিরোধের শক্তি দেয়নি। আমি হেরে ভূত, একটা zombie-র মতো। জেল জীবন, এর খাদ্যাভাস, এখানকার প্রতিমুহূর্তের তর্জনী উচানো শাসন আমাকে, আমার সহযোদ্ধাদের প্রতিক্ষণে বুঝিয়েছে আমরা এদের অনুগ্রহ এবং করুণার পাত্র। একমাত্র ব্যতিক্রম হতো যখন দেখতাম আমি ডাক্তারি পড়া বলে বোধহয় খানিকটা সম্ভ্রম পাচ্ছি – homo hierarchicus যাবে কোথায়? জেলারের ঘরে দেখা করতে এসেছেন বাবা। অন্যরা যখন সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলতো আমি আর বাবা তখন চেয়ার পেতাম বসে কথা বলার জন্য। দেখা করতে আসতো ভাই। ও আকাশ-পাতাল করে ফেলছে আমার জামিনের ব্যবস্থার জন্য – এ কোর্ট থেকে সে কোর্ট, এ জায়গা থেকে সে জায়গা। মা আসেননি সে অবস্থায় আমাকে দেখে সহ্য করতে পারবেন না বলে।
জেলের খাদ্যাতীত এবং সহ্যাতীত খাবার নিয়ে এক সকালে খাবার বয়কট করলাম। বেশ কিছু বন্দী জুটে গেলো আমাদের সাথে। জেলের নিয়ম ভাঙ্গা, নিয়মের ব্যত্যয় হওয়া এক অসম্ভব ঘটনা। পাগলা ঘন্টি বাজেনি আমাদের সৌভাগ্য। সন্ধের মুখে এসডিও এলেন। অল্পবয়সী। আমার সাথে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় নিয়ে অল্পস্বল্প গল্পগুজবও হল। সেটা আমার কাছে এক মৌহূর্তিক রিলিফ ছিলো। আমাদের অনশন উঠলো প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে। আমরা সেদিন মাংস খেয়েছিলাম। তার আগের রাতে সেলের মধ্যে আরেক সহযোদ্ধার উপস্থিতিতে এক ছোট সাইজের প্যানে আমাকে খালাস হতে হয়েছিলো। কতক্ষণ যে সেই “সুবাসে” ম ম করছিলো সেলের কুঠরি!
পরের দিন সকালে এক ডি আই বি অফিসার এলো আমাকে অন্য কোর্টে হাজিরা দিতে হবে বলে নিয়ে চললো। থামলো গিয়ে আরেক ডিস্ট্রিক্ট জেলে। আমি কথা বলে বুঝলাম কোর্টে হাজিরা নয়, আমার আপাতত আস্তানা এই নতুন জেল। ততোধিক নতুন জেলবন্দীরা এবং অবশ্যই জেলরক্ষীরা। আমার সেলের বাইরে সারাক্ষণই একজন গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতো। আমি কথা বলার চেষ্টা করে দেখলাম ওপরের কড়া নির্দেশ আছে – স্পিকটি নট। এখানাকার সেলে স্খালনের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল। আগের জেলের সে গন্ধ আর সহ্য করতে হয়নি। কিন্তু এক মহামূল্য অভিজ্ঞতা উপহার হিসেবে অর্জন করেছিলাম এ জেলে। দুবেলার ভাতে আক্ষরিক অর্থে অর্ধেকটা ভর্তি থাকতো পোকায়, কালো রঙের সমস্ত পোকা (সত্যিই কি সবটা বাছা যেত?) বেছে ফেলার পরে ভাতের পরিমাণ অর্ধেক হয়ে যেত। ডাল তরকারিও বাদ যেতো না। সুকুমার রায়ের ডানপিটে ছেলের খাদ্যবস্তুর কথা সেসময়ে মনে পড়েনি এমন নয় কিন্তু। সেও তো কপাকপ মাছি খেত। আমি আরেকটু ছোট পোকা খাচ্ছি এই যা! সেলের বাইরে বেরনোর কোন নিয়ম অন্তত আমাদের ক্ষেত্রে জেলে ছিলনা। ফলে সারাদিন ঐ কুঠরিতে। বড্ডো উপকার হল একটা। ভাই এসে বইগুলো দিয়ে গিয়েছিল। আমি অন্যান্য বইয়ের সাথে মার্ক টোয়েনের টম স্যয়ার সিরিজের সবকটা বই জমিয়ে শেষ করলাম। তার মধ্যে “অ্যাডভেঞ্চার্স অব হাকলবেরি ফিন” বোধহয় তিনবার পড়েছিলাম।
একদিন জেলের তৎকালীন আই জি মোক্তান এলেন পরিদর্শনে। কতো কষ্টের মধ্যে আছি তার খতিয়ান নিতে। আমাদের কথোপকথন হল ইংরেজিতে। আমার যাতে কোন অসুবিধে না হয় নির্দেশ দিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। আমাদের কথোপকথনের সময়ে বেশ কিছু জেলরক্ষী ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। কয়েদী আবার ইংরেজিতে কথা বলে! সে রাতে আমাকে ভাতের পোকা বাছতে হয়নি। আবার পরের দিন বাছা শুরু হতে জেলারের কাছ জানতে চাইলাম – কি হল? জেলারের সদন্ত সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল – ওটা তো মোক্তান সাহবের মুখের কথা, কোন লিখিত নির্দেশ নয়।
সম্ভবত প্রশ্ন করার জন্য এবার যাত্রা করলাম বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে গিয়ে দেখি এতদিনকার সহযোদ্ধাদের প্রায় সবাই পরপর সেলে রয়েছে। আবার ভেতর থেকে পাক খেয়ে উঠতে লাগলো গান। হোলটাইমার জীবনে বহু গ্রামে শুধু প্রাণখুলে গান গেয়ে সংগঠন গড়েছি। একসাথে ৩০-৩৫ খানা গানও করেছি। “সাতটি রঙের ঘোড়ায় চাপায়ে জিন” খুলে সেসমস্ত গান এবার লাভাস্রোতের মতো বেরোতে লাগলো। পাশের একের পর এক সেল থেকে সুরে-বেসুরে-অসুরে সব সহযোদ্ধা গলা মেলাতে থাকলো। দুহাতের মুঠোয় সূর্যকে ধরার আকাঙ্খায় আরেকবার ভেঙ্গে যাওয়া সত্তায় সংগীত বইতে লাগলো পাহাড়ি নদীর মতো এক হীরকখণ্ডের খোঁজ পেলাম জেলের লাইব্রেরিতে। জেলে বসে গীতা মুখার্জীর করা অনুবাদ (যদ্দুর মনে পড়ছে ১৯৫২ সালের অনুবাদ) – “অমৃতের পুত্র”। ইংরেজিতে – “নেকেড অ্যামং উলভস”। লেখক ব্রুনো আপিৎজ একবার, দুবার, তিনবার (ন্যাড়ার গানের মতো নয় কিন্তু) পড়ে ফেললাম এই অলোকসম্ভব গ্রন্থ, ততোধিক অসামান্য অনুবাদে। অনেক পরে সংগ্রহ করেছি ইংরেজি বইটি আমেরিকার এক সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের দোকান থেকে। অল্প কথায় উপন্যাসের কাহিনী এরকম – হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর প্রহর গোনা বন্দীদের মাঝে সুটকেস-বন্দী হয়ে কোনরকমে বেঁচে আসে এক নিষ্পাপ মানবশিশু, এক মানবক এসে পৌঁছয়। সবার আদরে সবার কোলে কোলে সে বড়ো হতে থাকে – দিনের হিসেবে, মাসের হিসেবে। গেস্টাপোর শ্যেনচক্ষুর অন্তরালে। অবশেষে যখন রুশ বাহিনী এসে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে সবাইকে মুক্ত করে তখন সবার উত্তোলিত হাতে হাতে সে ঘুরতে থাকে বিজয় পতাকা হিসেবে – জীবনের বিজয় পতাকা। একটি নবোদ্গত জীবনকে মৃত্যুর দিকে পা বাড়িয়ে রাখা এই না-মানুষ হয়ে যাওয়া কমরেডরা বাঁচিয়ে রেখেছে জীবনের তীব্র উল্লাসে – The child bobbed like a nutshell above the surging heads. It twirled in the eddy through the narrows of the gate. The current swept it along on its liberated billows, which were no longer to be restrained.
একদিন আমিও বেরোলাম জেল থেকে, জামিন নিয়ে। ঐ শিশুটির মতো নয়, অমৃতের পুত্রের মতো নয়। জেলের গেটে ভাই আর ওর কয়েকজন বন্ধু গিয়েছিলো। গিয়েছিলেন আমাদের সহমর্মী এক ডাক্তার দাদা তাঁর জিপ নিয়ে।
বাড়িতে ফিরতেই ভাইয়ের এক বন্ধু বললো – মাসীমা, বাসুদার (আমার ডাকনাম) ছবি আমাদের সবার ঘরে টাঙ্গানো উচিৎ। আমি মাথা নীচু করলাম। চোখের দুকোণা ভিজে গেলো। এভাবে ফিরতে তো চাইনি! ফেরার সময়ে তো মাথা উঁচু নেই। ঐ শিশুটির মতো বিজয়পতাকা হয়েও বেরিয়ে আসিনি।
কিন্তু এখনো চারণ কবির মতো গান গাওয়া যায় হয়তো বা – সমবেত কন্ঠে, সহমর্মিতার বোধে। হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে ফিরে আসা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ভিক্টর ফ্রাঙ্কল-এর অনুভুতি ছিলো (Man’s Search for Meaning, 1946) – We knew that we had nothing to lose except our so ridiculously naked lives. তাঁর মনে হয়েছিলো – The only thing that had changed for them was that they were now the oppressors instead of the oppressed.
সালটা ২০১৯। কথাগুলোও বড্ডো সত্যি। আবার সমবেত সঙ্গীত গাওয়ার বাতাস কি বইছে? The answer, my friend, is blowing in the wind!

2 comments:

  1. অসাধারণ। আর কী বলব। পড়তে পড়তে কেঁপে গেছি কতবার। ইতিহাস আর জীবন পাশাপাশি হেঁটেছে এই লেখাটিতে।

    ReplyDelete
  2. বুকের ভেতর টনটন এক আবেগ-
    চোরাস্রোতে কখন অন্তর্জলি,
    আত্মকে ঐ অচেনা ছায়ায় চিনে
    বুকের চাঁদের তবুও একফালি।

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত? ঋত্বিক ঘটক :   চলচ্চিত্র তৈরির প্রাথমিক লক্ষ্য মানবজাতির জন্য ভাল কিছু করা। যদি আপ...

পাঠকের পছন্দ