শরতের কাশ বা শিউলির মত আদৌ
স্বাভাবিক ছিলনা। এই যে এখন দু-একজন আমার নামের আগে এক বিশেষণ যোগ করে
বসেন কখনো-সখনো, তা হবার কিন্তু কোনও
সঙ্গত কারণ ছিলনা আদৌ। না যদি বাবা চলবার
পথের ইটটাকে সবেগে সরিয়ে দিতেন। যদিও ওসবের পরেও
বাবার চিন্তামুক্ত হবার মত কোনও সদর্থক ব্যাপারও কিছু ঘটনা। বরং দেখা গেল সরানো
ইটের তলাকার কিছু নীরক্ত দুব্বোর মুখ উন্মুখ হয়ে আছে সূর্যের ছোঁয়া পেতে। শুধু তাই নয়, জল হাওয়ার সঙ্গ পেলে তারা যে অচিরেই নৈবেদ্যর
উপকরণ হয়ে উঠতে পারে, হাতে পারে রোজনামচার অনাস্বাদিত মনন-সঙ্গী, সে আভাস ও যেন পেতে রাখা কানের রন্ধ্রে
রন্ধ্রে কড়া নাড়তে লাগল।
কবে কিভাবে
কখন কোন্ জীবন্ত স্বপ্ন-বীজ মাথায় চেপে বসল আর দৃষ্টির মোহাঞ্জনলোকে
পরিয়ে দিল নবতর ব্যঞ্জনার অদ্বয় প্রলেপ তা ইতিহাসের গবেষকের বিষয়। তবে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বাবা যখন তুড়ি মারার উড়িয়ে দিলেন গভর্নমেন্ট
আর্ট কলেজে পড়বার মনোবাঞ্ছা, তখন আমার
মনের ওপর বিরাশি সিক্কা ওজনের এক আঘাত নেমে এল। দীর্ঘদিন লালিত
ছবি আঁকা শিখবার ইচ্ছা যে এভাবে দমিত হবে ভাবতে পারিনি। কলকাতার বদলে ডায়মণ্ডহারবারের কলেজে পড়ে আমার স্বপ্নভঙ্গের
যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে তাও ভাবিনি কখনো। অগত্যা কলেজে প্রবেশ। কিছু দিনের মধ্যে জানতে পারলাম কলেজ থেকে ছাত্রছাত্রী অধ্যাপকদের লেখায় সমৃদ্ধ
হয়ে একটা পত্রিকা বের হয় বটে, কিন্তু
সেখানে ছাত্রছাত্রীদের আঁকা ছবি সংযোজনের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমাকে তো কিছু করতেই হবে! কারণ অনুভবের রন্ধ্র-পথ লক্ষ্য করে তখন ধেয়ে আসছে
হাজারো বিষয়ের দুরন্ত গতির ফাস্ট বল। নিরন্তর সেই ধেয়ে
আসা। কল্পনায় নতুন নতুন রোদের ঝিকিমিকি। ইতোমধ্যে কলেজের
নবীন বরণ উৎসবে আমার লেখা কবিতা ছাত্র-ছাত্রীদের লিখিত কবিতার মধ্যে একমাত্র কবিতা, যা
আবৃত্তি-যোগ্য হিসেবে নির্বাচিত হল। উৎসাহের পল্ তেয় অজান্তে কে যেন আগুন ধরিয়ে দিল তখন। কলম হাতে কাগজের
মুখোমুখি রোজই সেসময় থেকে। বাবার কানে উঠল
আমার এই অপকর্মের কথা। পড়ার বদলে রাত জেগে এসব অপকর্ম কোন অভিভাবক বা সহজে মেনে
নেবেন। আমার ক্ষেত্রেও তাই বকাবকি জুটল বেশ। কিন্তু অকস্মাৎ
একদিন আমার কলমের ডগা দিয়ে বেরিয়ে এল ‘আমার কথার শব্দরা সব উঠে দাঁড়াক’ এবং তা ক্রমশ
আস্ত একটা কবিতা হয়ে দাঁড়াল গুরুজনদের বিচারে। তখন বোধহয় একটা
গতি সঞ্চারিত হল ভিতরে ভিতরে। মনে হতে লাগল অজস্র-ভ্রূণ কিলবিল করছে আমার ভিতরে। তারা মুক্তি চায়, বন্ধনমুক্তি; চায় মুক্তির আনন্দ। তখন তাদের মুক্তি
না দিয়ে কোনও উপায় ছিলনা আমার। অনেকটা অনায়াসে
তারা নেমে আসতে লাগল কবিতার আকারে তখনকার ‘বঙ্গ-লিপি’ ‘নব-লিপি’ নামের খাতায়। তবে এখন নির্দ্বিধায় বলতে পারি কবিতা নামের হলেও তারা সবাই কবিতা ছিলনা, বেশির ভাগই ছিল পদ্য। যাই হোক, ওরা কিন্তু আমার রক্ত সঞ্চালনে বিশেষ সাহায্য করেছিলো, এছাড়া সে সময়ে দুটি গান আমাকে সঞ্জীবনী যোগাত সব সেসময়ে। প্রথমটি ‘ঘরের ভিতর অচিন-পাখি কেম্ নে আসে
যায়’ আর দ্বিতীয়টি ‘লোকে বলে বলেরে
ঘর বাড়ি ভালো নয় আমার/ কি ঘর বান্ধিনু আমি শূন্যেরও মাঝার/
লোকে বলে বলেরে’ এই গান দুটির গূঢ়ার্থ আমার
অজানা কিন্তু এদের
শব্দ সংযোজনা, বাক্য-বন্ধ আমাকে মুগ্ধ
করত, বিভোর করত। মগ্নতার বীজমন্ত্রে
দীক্ষিত করত। পড়ার মতো বই ও পেতাম না তেমন। এদিক ওদিক থেকে
নিয়ে চলছিল পড়াশোনা ও লেখা। কিন্তু সাতের দশকের
শেষে যখন কর্মসূত্রে কবি বাসুদেব দেব ডায়মণ্ডহারবারে এলেন তখন তিনি আমার জন্য খুলে
দিলেন তাঁর গ্রন্থ ভান্ডার। রিলকে বোদলেয়ার, হোল্ডারলীন ডিকিনসন সহ বিভিন্ন বিদেশী কবি সাহিত্যিকের বই
ও দরবারি আলোচনায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন আমার জঠরাগ্নির খিদে তৃষ্ণা। তখন থেকেই পুরো-দমে কবিতার পথে। চলনে মননে কথোপকথনে কবিতা আমার অন্তর সঙ্গী। সর্বক্ষণ কবিতা
চিন্তা জারি থাকে অনর্গল। তাই, যা হয়ে
উঠতে পারত তুলিতে রঙের প্রলেপনে ক্যানভাসের বুকে অফুরান আনন্দের রসদ, তা গতি বদ্ লেবাধা পেয়ে উছ্ লে ওঠা জলের মত আরও গতি প্রাপ্ত হয়ে কবিতার
ভাষায় শব্দের বাঁধনে নতুন রূপের সন্ধানে
সতত অভিযাত্রী। মাঝে মাঝে বঙ্কিম
মাঝে মাঝে বঙ্কিম চন্দ্রের কথাকে আশ্রয় করে বলতে ইচ্ছে হয় আমি কবিতার জন্য বলি-প্রদত্ত!
হয়তো করে উঠতে পারিনি কিছুই, তবুও বোধ করি, কবিতাজ্বরে আক্রান্ত হলে রেহাই মেলেনা আর। মুক্তি নেই বলে কবিতার হয়ে ওঠা বা
না হয়ে ওঠা চিরকাল গুরুত্ব পেয়ে এসেছে খুব বেশি করে। না হ’য়ে উঠলে যে বিষাদময়তা তা বর্ণনার অতীত, একই রকম ভাবে কবিতা হয়ে উঠলে যে আনন্দ তাও বর্ণনার অতীত। এরই মাঝে নির্মাণ আর সৃজন প্রসঙ্গও এসে পড়ে। যদিও তা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্র
আলাদা। তবুও আমার কেমন যেন মন টানে সৃজনের অনাবিল রৌদ্রে নিজেকে মেলে দিতে, নির্মাণের খুটখুট প্রচেষ্টা আমাকে দূরে সরিয়ে রাখে। এ প্রসঙ্গে ষাটের উল্লেখযোগ্য কবি বাসুদেব দেব এক সুন্দর গল্পে বোঝাতেন- কবিতা হ’ল সাত-মহলা বাড়ির রাণী, তিনি একডাকে বাইরে আসবেননা। তাই বারবার কড়া নাড়লে একদিন নিশ্চয়ই দরজা খুলে নাছোড়বান্দাকে দেখতে চাইবেন। আমার আজীবন প্রচেষ্টা
ও পথেই ধাবিত। কবিতার দেখা না পাওয়া পর্যন্ত সে প্রচেষ্টা চলতেই থাকবে। ঐকান্তিক একাগ্রতার সাথে নাড়া বেঁধে তাই বসে থাকা।যদি কবিতার দেখা পাই কবিতা পথের পথিক হিসেবে ওই না পাওয়ার
যন্ত্রণায় চিরদিন জর্জরিত। তাই নতুন করে আত্মজীবনী
রচনার এই খণ্ডাংশ অনেকটাই অসম্পূর্ণ। তবুও গুরুদেব এর ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’ কে কানে নিই,
পাথেয় করি; তখন বেঁচে থাকা, জেগে থাকা আলাদা মাত্রা পেয়ে যায়। ‘আরো আরো প্রভু আরো/ এমনি ক’রে আমায় মারো’ মনে করতে করতে বেঁচে থাকার চেষ্টায় কবিতার কাছে ধর্না দিই, প্রার্থনা করি। এই ধর্না ও প্রার্থনা
চলবে আজীবন। ভাগ্যিস! বাবা ছবি আঁকার জগৎ থেকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন
অভিমুখ, সে কারণেই হয়তো শব সাধনা-রূপ শব্দ সাধনার পঞ্চমুন্ডি আসনে সুনিবিড়
একা। অবিশ্রান্ত একাকীত্বের
ঘোরতর গহনে যখন অকস্মাৎ কোনো অথৈ সুদূরের সুমন্দ্র ডাক
ঢেউয়ে ঢেউয়ে বিলি
কাটে, তখন নিশিতে পাওয়া আমি আমার
সমস্ত থেকে বেরিয়ে অফুরান দৌড়োতে থাকি
তেপান্তর নির্জনতা পার হওয়া কোন্ সে সংক্রমণে সংক্রমিত আমি,
আমাকে ঠিক খুঁজে পাইনা যেন। অনৈসর্গিক এক অস্থিরতা গ্রাস
করে আমাকে। এর কোনও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ অর্থান্তর নেই আমার কাছে। আমাকে সম্পূর্ণ
অন্ধকারে রেখে গলা থেকে গোঁ গোঁ শব্দে বেরিয়ে
আসে এক অপ্রাকৃত স্বর-
অনন্ত
দিয়েছে ডাক
উত্তাপ
বুঝিনা আর
নতজানু বসি বৃক্ষতলে ওই
হাত
পাতি
পরিপূর্ণ
মাখি ওই ছোঁয়া
সেই
থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আমি
তানে
রাখি ভিতর মহল
চাপ
চাপ লিখি অন্ধকার একা
একাকীত্বে
ঘোর
No comments:
Post a Comment