এখন দেখি দিনগুলো
ফিল্মস্ট্রিপ চলার মতো চলে যায়। দৃশ্যের স্থির-চিত্রের কোলাজ একের পর এক আমার
চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে আর আমি নিতান্তই একজন বোকা দর্শকের মতো সারাদিন
সারারাত বসে আছি স্ক্রিনের সামনে। অবচেতনে কখন ঘুমিয়ে পড়ি টের পাই না। ঘুম ভাঙলে
শুধু দেখি সেই ফিল্মস্ট্রিপের অনেকটা ফাস্ট ফরাওয়ার্ড হয়ে গেছে। আমি সেসব থেকে বাদ
পড়ে গেছি শুধু। তবে কিছু কিছু দৃশ্য কীভাবে মনের ভিতর থেকে যায় বুঝতে পারি না। চোখ
বন্ধ করলেই দেখি সেসব ছবি ভিতরে ভিড় করে এসেছে। অনেকটা আগেকার দিনের ছবির নেগটিভের
মতো। তাতে দৃশ্যের অবয়ব আছে... ইশারা আছে
শুধু দৃশ্যের স্পন্দন নেই। যদিও সেসব দৃশ্য আমাকে কখনও আগে থেকে জানিয়ে আসে নি।
অন্ধকার গলিতে হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের মুখে যখন দেখি রাস্তা জুড়ে পাড়ার নেড়িটা শুয়ে
আছে, ঠিক সেরকম আকস্মিকতায় সব সামনে চলে আসে। গত সপ্তাহেই একদিন বাড়ি ফেরার সময়ে
দেখছিলাম একটা ছোট্ট বেড়াল ঝিরঝিরে বৃষ্টি থেকে নিজের গা বাঁচাতে একটা কার্ণিশের
তলায় গুটি মেরে আছে। সে কোথা থেকে এলো...তার কে আছে এসবের কিছুই জানি না। কিন্তু
কীভাবে রাতে লেখার খাতাটা খুলতেই তার কথা আমার মনে পড়ে গেল। ওয়ার্ডপ্যাডের সাদা
স্ক্রিনে মাউস পয়েন্টার আমার দিকে তাকায় পিট পিট করে আমিও তার দিকে তাকাই। বেড়াল
ছানার কথা ভাবি।
লিখতে গেলে বার বার মনে হয় লেখায় যেন আমি বড্ড বেশি বেশি
অশ্লীলভাবে আছি। আমার অবচেতনের এসব ঝিম ধরানো প্রলাপ দুপুরের ঘুঘুর ডাকের মতই
একঘেয়ে। তাও বলি, একটা দৃশ্যের কথা আমার
বারবার মনে পড়ে। বিশেষ করে আমার সারাদিনের ক্লান্ত ‘আমি’ যখন এই ওয়ার্ড
ফাইলের সাদা স্ক্রিনের সামনে বসি। মনে হয় একটা অন্ধকার অডিটোরিয়ামের মঞ্চে একা
দাঁড়িয়ে আছি। মাউস
পয়েন্টার আমার দিকে চোখ পিট পিট করে তাকায়। আর আমি কীভাবে যেন একটা টানেলের মধ্যে
দিয়ে চলে যাই এক সন্ধের পেটের ভিতর। সেই সন্ধ্যের গুহায় আমাকে নিয়ে গেছিল আমার এক
বন্ধু। নিতান্তই আড্ডার ছলে সেখানে পৌঁছাই। জায়গার নাম আর মনে নেই। তাই সেখানে
ফিরে যাবার রাস্তা একমাত্র এই আমার স্মৃতি। দামোদরের ঢালু সবুজ চর। নদীর ওপারে তখন
দোপাটি চারার উপরে সন্ধ্যের বেগুনী আলো নেমে আসছে। আমাদের রসদ কয়েক বোতল বিয়ার আর
দু প্যাকেট সিগারেট। অনেকক্ষণ সময়ের পর আমাদের দুজনের মধ্যে নীরবতা। খেয়াল
করি মাথার ভিতরে নেশার আবছা মেঘ নেমে আসার
মতো নদীর কালো জলের উপরেও আবছা কুয়াশা। আমাদের ডান পাশেই নদীর পিঠের অনকটা উপর
দিয়ে চলে গেছে ঋজু রেলব্রীজ। ওপারের ফুল গাছের চারার পাতাগুলো কালো কালো লাগে।
রেলব্রীজে মৃদু হলুদ আলো। অল্প স্যাভলনে ভেজানো তুলোর মতো হলুদ হ্যালোজেনের রঙ
কিছুটা এসে পড়েছে নদীর কালো পিঠে। ব্রিজের ওপর দিয়ে একসময়ে ট্রেন চলে যায়। খোপ খোপ জানালা দিয়ে
ট্রেনের সাদা আলো এসে পড়ে নক্ষত্রের মতো। হয়ত জানালায় কোনও মলিন মুখ বসেছিল। সে
হয়ত আমাদেরও দেখেছে, যেমন করে আমি তাকে দেখেছি। তার কপালের ঘাম এককোনে নুন হয়ে জমে
আছে। সেই যুবতীর চুল হয়তো মৃদু ওড়ে। তাকে আমি দেখিনি। সেও হয়ত দখেনি আমায়। তবে সেই
মুখ কেন আমাকে বার বার সেই ম্যাজিক সন্ধ্যের গুহায় নিয়ে আসে জানি না।
No comments:
Post a Comment