Monday, July 22, 2019

দ্যা বার্ডস- অ্যালফ্রেড হিচকক যা বলতে চেয়েছেন- “আহা! বিষণ্ণতা”-- রিমি মুৎসুদ্দি






মোবাইলে সময় বলছে রাত দুটো বেজে সতেরো মিনিট পার হল। মেয়েটা একটা টর্চ হাতে সিঁড়ির কাছে গেল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। প্রতিটা পদক্ষেপে দ্বিধা। আর চোখে কৌতূহল। দ্বিধা ও কৌতূহল কাঠের সিঁড়িতে শব্দ করতে করতে একটা ঘরের দরজায় টর্চের আলোর ওপর একসাথে মিশে যায়। আর সকলে মিলে দরজার নব খুব ধীরে সন্তর্পণে ঘোরাতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে দরজাটা খুলে গেল আর সমুদ্র বাতাসের ঝাঁপটা এসে শরীর ছোঁয়ার আগেই কতগুলো সিগাল ঝাঁপিয়ে পড়ল। কখনও ডানায় কখনও ঠোঁটে ক্রমাগত মেয়েটার মাংস খুবলে উপড়ে দিল শরীর থেকে। একের পর এক সিগালের ক্রমাগত আক্রমণে প্রাণ হারাবে বুঝি সে




শেষপর্যন্ত মেয়েটা প্রাণ হারাল কি না আর দেখতে পারছে না পর্দার ওপ্রান্তে থাকা মুঠোফোন হাতে কুশানে হেলান দিয়ে ডিভানে বসে থাকা আরেকটা মেয়ে। কিছু আগেই যে মেয়েটা একজন ঘুমন্ত মানুষকে বার্তা দিল
-এখন রাত দুটো সতেরো। এলফ্রেড হিচককের দ্যা বার্ড দেখছি। কী মারাত্মক থ্রিল! আই যাস্ট কান্ট সি দিস!”
এলইডি স্ক্রিনের পর্দায় মেলেনি ড্যানিয়েল তখন পাখিদের আক্রমণে অর্ধমৃত প্রায়। চেতনা অবলুপ্তির পথে। কোনোক্রমে মেলেনির প্রেমিক মিচ এসে ওকে উদ্ধার করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। মিচের সারা শরীরও পাখির ঠোঁটের, পায়ের নখের তীব্র আক্রমণে ক্ষত বিক্ষত। হাতের ব্যাণ্ডেজ চুয়ে, কপাল বেয়ে রক্তের ধারা নামছে আর কোলে তার প্রেমিকার চেতনাহীন দেহ। এই দৃশ্য দেখে কিন্তু প্রেম বা রোমান্টিসিজম জাগে না। এই দৃশ্য দেখেও সন্দেহ জাগে হিচকক কি একটা প্রেমের ছবি বানাতে চেয়েছিলেন? না একটা থ্রিলার? না একটা সামাজিক সচেতনতা জাগানো সিনেমা?


একটা প্রশ্নের বহুবিধ উত্তর থাকে। এই প্রশ্নের একাধিক উত্তর পেতে গেলে চলে যেতে হবে একদম শুরুতে। লাভ বার্ড দিয়ে শুরু একটা আপাত প্রেমের গল্প আসলে সভ্যতার সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তার দর্শকদের। ১৯৬৩ সালে সিনেমাটা যখন তৈরি করেছিলেন হিচকক তখন হয়ত মোবাইল ফোনের কনসেপ্টই আসেনি আমাদের পৃথিবীতে। কিন্তু একদিন সভ্যতার এই সঙ্কট আসবেই পরিবেশের ওপর। কিছুটা সেই বার্তাই দিয়ে গেল ‘দ্যা বার্ডস’ সিনেমাটা। যে মেয়েটা মোবাইল হাতে টিভির পর্দায় পাখিদের সম্মিলিত আক্রমণে একটা শহর ধ্বংস ও একের পর এক মৃত্যু অথবা হত্যালীলা দেখে চলেছে। তার কানে এসে বাজল বৃদ্ধা অরিনিথলজিস্টের একটা সংলাপ, “This epiphenomenon is caused by a curse.”  সানফ্রান্সিস্কো থেকে আসা নবাগত অতিথির দিকে আঙুল উঁচিয়ে এক ভীত সন্ত্রস্ত মা বলে উঠেন, “you are the curse. You bring the curse in our Bodega Bay.”  



সত্যজিৎ রায় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমায় পক্ষী বিশারদ পাহাড়ি সান্যালকে দিয়ে প্রায় এইরকমই একটা সংলাপ বলিয়েছলেন। একটু আলাদা। একঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে আকাশে আর সেদিকে তাকিয়ে পাহাড়ী সান্যাল বলছেন,
-একদিন আমরা সবাই থাকব কিন্তু এই পাখিরা আর থাকবে না।
খাঁচায় বন্দী ছোট্ট দুটো লাভবার্ড যদি গল্পটির শুরু করে থাকে তো তা শেষ করল একদল নিরীহ সাধারণ কাক, একদল সিগাল ও আরও অনেক নাম না জানা পাখির দলবদ্ধ আক্রমণ। আর সেই আক্রমণের কাছে মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণ। যুগ যুগ ধরে যাদের বন্দী করে, খাঁচায় পুষে অথবা মাংস খেয়ে সভ্যতা এগিয়ে চলেছে ক্রমশ। সেইসব আমিষ স্মৃতি হঠাৎ করেই কি ফিরে এসেছিল? ঠিক তা নয় বোধহয়।


প্রবল রাগে কখনও মানুষ চাইছে সব ক্ষমতা অস্ত্র দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত পাখিদের ধ্বংস করে দিতে। তার নিশ্চিন্ত খাওয়ার টেবিলে হঠাৎ করে ফায়ারপ্লেসের আগুন উপেক্ষা করে দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে ছোটো ছোটো অসংখ্য পাখি। এলোমেলো তছনছ শুধু নয় রীতিমতো যুদ্ধের সৈনিকের মতো উদ্ধত তাদের আক্রমণ। কী আশ্চর্য! তখনও তো মোবাইল ফোন আসেনিএসেছি কি স্যাটেলাইটের অতিউপদ্রব? তাহলে? ওই অত আগেই দূষণ নিয়ে কত সচেতনতা অথচ পৃথিবীর দূষণ কি আটকানো গেছে? পাহাড় কেটে বন ধ্বংস করে বসতি আর উন্নয়ন এগিয়ে চলেছে। কোথায় থাকবে বন্যপ্রাণীরা? সে প্রশ্নের উত্তর মাঝেমাঝে দাঁতাল হাতি আর উন্মত্ত চিতা এসে দিয়ে যায় লোকালয়ে। কিন্তু আকাশপথে যাদের বিচরণ তারাও তো হারিয়েছে তাদের বাসস্থান একের পর এক গাছ কাটার সাথে সাথে ভেঙে পড়েছে তাদের বাসা, সদ্য পাড়া ডিম আর সেই সঙ্গে তারা হারিয়েছে স্বাধীন সহজ বিচরণ



পায়রা এসে এসির চালে খচখচ শব্দ করলে অথবা বারান্দায় টবের গাছের শেকড় নাড়িয়ে দিয়ে গেলে সেই লতানে গাছের দিকে চেয়ে আর সমস্ত বারান্দা জুড়ে ছড়ানো নোংরার দিকে তাকিয়ে কতবার যে তাকে মৃত্যুদূত মনে হয়েছে! মৃত্যু আর অবলুপ্তিকে বরণ করতে করতে ওদের মারমুখী হয়ে ওঠা মোটেও জাদুবাস্তবতা নয়। প্রকৃতি তার ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে প্রতিশোধ নেবেই আর তখন খাঁচায় বন্দী পাখির মতোই উন্নয়নকেও আস্তে আস্তে খাঁচায় অথবা ঘরের কোণে মুখেচোখে মৃত্যুভয় অস্তিত্ব সঙ্কট নিয়ে সেঁধিয়ে যেতে হবে।
সেদিন আমরা সবাই থাকব। আর আমাদের সাথে আমৃত্যু থাকবে চিরবিষণ্ণতা। শুধু তাকে আমরা তখন আর বলতে পারব না - “আহা! বিষণ্ণতা!”
             


12 comments:

  1. চমৎকার লিখেছ। আরো বড় করে লেখ। দ্য বার্ডস ছবি নিয়ে ভাবা দরকার। লেখা দরকার। ছবিটি নতুন করে দেখা দরকার।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ ও প্রণাম অমরদা।

      Delete
  2. খুব ভাল লাগল রিমি। এই সময়ে দাঁড়িয়ে নতুন করে দেখা এক ক্লাসিককে।

    ReplyDelete
  3. অনেক ধন্যবাদ বিশ্বদীপ আপনাকে।

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো লিখেছিস।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভালবাসা সৌমনাদি

      Delete
  5. ছবিটার apocalyptic message এখনো যে আমাদের ভাবিয়ে দিতে পারে, সেটি মনে করিয়ে দিল এই লেখাটুকু। পাখিরা প্রতীকমাত্র। তাদের হিংস্রতা, আমাদেরই কৃতকর্মের সারাংশ। এখনো জ্বলজ্বলে সেই সংলাপ..."Back to your gilded cage, Melanie Daniels"

    ReplyDelete
    Replies
    1. খুব জরুরী কথা লিখলেন। শ্রদ্ধা জানাই

      Delete
  6. সত্যি বলতে কী, সেই ছোটবেলায় দেখা সিনেমা তোমার লেখায় অনেক অন্য ভাবে ফিরে এল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ দাদা। শ্রদ্ধা জানাই।

      Delete
  7. তোমার লেখাটা মনে পড়িয়ে দিল যে হিচককের সেই অসাধারণ ছবিটা বড় পর্দায় একদিন দেখবো বলে কবে থেকে বসে আছি, আজও দেখা হয়নি। তবে না দেখা হলেও, ইদানিং একটা আতঙ্ক ক্রমশ: এগিয়ে আসছে বোঝা যায়। এবং বিষণ্নতা। 'This is the way the world ends. Not with a bang but whimper'.

    ReplyDelete
  8. ভালো লিখেছো। প্রত্যেকটি ক্লাসিককেই আরেকবার করে ঘুরে দেখা ঘুরে পড়া উচিত আমাদের।

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত? ঋত্বিক ঘটক :   চলচ্চিত্র তৈরির প্রাথমিক লক্ষ্য মানবজাতির জন্য ভাল কিছু করা। যদি আপ...

পাঠকের পছন্দ