Sunday, July 21, 2019

ফেলে আসা মগ্নতারা -- জাতিস্মর





১.

কাছেপিঠে কেউ রেডিওর নব ঘোরালে নির্জনতার শব্দ ভেসে আসে বহুদূর থেকে। কফির কাপে চুমুক দিলে আশেপাশে কোথাও মেঘ করে আসে খুব। দু-একটা ফুল ঝরে পড়ে খোঁপার থেকে বাতাসের ষড়যন্ত্রে। জানলার কাচে যেন কারা জোর করে আয়না বসিয়ে দেয়। প্রতিফলন ঝনঝনিয়ে ওঠে থেকে থেকে। পসরা গুটিয়ে ফেলে পাখির দল। সেসময় ঘর দোরে খিল এঁটে অন্ধ গায়ক হয়ে ব'সে থাকে মন। মুখড়া ধরার পরই ঘরে ফেরার পথে আগন্তুকের মত দরজায় টোকা দেয় বর্জিত গান্ধার। সুর পিছলে যায় বারবার কোমল ধৈবতের গা ঘেঁষে। এ কী বিড়ম্বনা! খান খান হয়ে মগ্নতা প'ড়ে ভেঙে যায় সঞ্চারী থেকে। তারপর কী দুর্বৃত্ত রাত নেমে আসে ফাঁকা ছাদ জুড়ে! হাওয়া দেয় জোর -

এখন মনে হয়, তোমার গলায় জৌনপুরী ছিল মায়ের মত শুদ্ধ...

২.

মধ্য বৈশাখের দিকে বাতিল ছিটের মত সময় প'ড়ে থাকে দর্জির দোকানের পাশে। অদ্ভুত রং বুননের কাজ চলে বাতাসের সেলাইয়ে। মনে পড়ে স্টেশনের পাশের গলিতে রঙীন ক্যানভাস বিক্রি করতো হাফ প্যান্ট পরা ছেলেটি। ট্রেন এক একটা স্টেশনে থামলে এঁকে ফেলতাম দুরূহ সব মুখোশের রেখাচিত্র। এক একদিন সন্ধ্যেবেলা মুড়ি চিবোতে চিবোতে মনে হত অকাডেমির পাশে মাইন্ড আর্ট এর একটা সংগ্রহশালা খুললে বেশ হয়। অবশ্য দৃশ্যমগ্নতায় গভীরতার কোনো মাপ হয়না জানি তবু কখনো কখনো বৃষ্টি রং এ ডুবে যেতে দেখেছি পৃথিবীকে কোনো ফাঁকা ক্যানভাসের নদীতে। স্মৃতি ঘাঁটতে খুঁজে পাই সে এক কোনো বিকেলে চায়ের আড্ডার ফাঁকে যেন সেসব রেখে এসেছি অবচেতন এর ঘরে। বহুদিন যাওয়া হয়না ওদিক পানে আর ---

শুধু মাঝে মাঝে "দ্য বার্নিং জিরাফ" এর ড্রয়ার গুলোর কথা মনে পড়ে...

৩.

কখনো কখনো ঠিকঠাক নামতা পড়তে পড়তে পৌঁছে যাওয়া যায় কোনো দূরের পাহাড়ে। মন শেরপাদের গ্রামে গিয়ে শিখে আসে আতিথেয়তার জ্যামিতি। রোদের মায়াজন্মে ভেসে আসে মনাস্ট্রির টুং টাং সুর। বিপজ্জনক ঝর্ণা পেরিয়ে উষ্ণতাকে রেখে আসা যায় আদিম পাহাড়ের গুহায়। সাথে দোতলার ব্যালকনিতে কুড়িয়ে আনা বরফকুচি। এই বরফকুচিদের আবার  নিজস্ব জীবন ধর্ম আছে। আছে শৃঙ্খলা, নিমগ্ন জলের দায়বদ্ধতা। কুড়িয়ে নিতে নিতে বুঝতে পারি পাহাড়ে বৃষ্টিপাত হলে উপত্যকা আরো একবার পাহাড়ের প্রেমে পড়ে। আর তুষারপাতে যেন গান্ধর্ব্য মতে মালাবদল হয় তাদের। ফায়ারপ্লেসের আগুন উস্কে দিলে যেন ম্যাল জুড়ে ঘুম নেমে আসে। ভাঙলে দেখা যায়, রোদ ব্যালকনিতে সকালের খবরের কাগজ ছুঁড়ে দিয়েছে আর আধখানা পাহাড় আঁকা ডায়েরির পাতা গুলো ওড়ে পুবের হাওয়ায় -

অত জ্যামিতি মেনে পাহাড় আঁকা হয়না আর। তবে গরমকালে এখন যেন কেমন বারবার নামতায় ভুল ক'রে ফেলি...

৪.

তারিখ পুরোনো হ'লে মাঝে মাঝে পুরোনো চিঠিগুলো খুলে সোফায় ব'সে পড়ে মন। পোস্টকার্ড যেন হয়ে ওঠে একলহমায় সিনেমার পর্দা। অক্ষরের দৃশ্যাভিনয় আর যথোপযুক্ত ভাবনার মারপ্যাঁচ দেখতে দেখতে দু কাপ কফি খেয়ে নেওয়া যায়। কিছু কিছু চিঠি বেশ বিপাকে ফেলে দেয় প্রতিবারের মতই। যেন কতদিনের বলতে চাওয়া গুলো একসঙ্গে কালি মাখামাখি ক'রে ঢুকে পড়েছে একদৃশ্যে। পরিচালক কাঁটাছেঁড়া না করেই চিঠি ছেড়ে দিয়েছেন মনের উদ্দেশ্যে। বুঝতে বুঝতে বেশ বেলা গড়িয়ে আসলে বোঝা যায় শো টাইম শেষের দিকে। তখন মনে পড়ে সাসপেন্স নেই ব'লে এরকম কত চিঠি হয়তো লেখা হয়েও মুক্তি পায়নি কোনো প্রেক্ষাগৃহে। এদিকে কোনো একটা বিশেষ চিঠি খুঁজতে গিয়ে দেখি দক্ষিণের জানলায় বিকেল দাঁড়িয়ে আছে। ঝুপ ক'রে সন্ধে নামার আগে মনে পড়ে বেশ কিছু বন্ধু চিঠি লেখেনি অনেকদিন -

এত যে পুরোনো দৃশ্যের ভিড় আগলে রাখা! উড়োচিঠি কোথায়? প্রেক্ষাগৃহের ঠিকানা তো একই আছে...

৫.

ভীষণ জোরে পুবের হাওয়া দিলে মাঝে মাঝে চোখের সামনে অনেকগুলো পথ খুলে যায়। স্মৃতি থেকে বন্ধুদের টেলিফোন এর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হ'লে, পায়ে পাযে হেঁটে সেই পথ গুলো দিয়ে বেশ বেরিয়ে পড়া যায় সান্ধ্যভ্রমণে। পথের প্রতি বাঁকেই পথ নির্দেশ বোর্ড। বেশ নিরুদ্বিঘ্ন চলাচল হ'লেও মাঝে মাঝে এক একটা বাঁক ঘুরলে কোথা থেকে যেন এক গোছা ফুল এসে পড়ে পায়ের কাছে। ভালোভাবে দেখলে বোঝা যায় ওগুলো কিছু টুকরো কথা, তবে স্পষ্ট বোঝার আগেই এসে যায় পরের বাঁক এবং তার সাথে সেই ফুল গুলো যেন বিভিন্ন পংক্তি হ'য়ে উড়ে বেড়ায় আশেপাশে। তাদের উৎস কবিতা খুঁজতে খুঁজতে পরের বাঁক ঘুরতেই কেমন ঝুপ ক'রে রাত নেমে আসে। অন্ধকার হ'য়ে থাকে বেশ। যেন কোনো গভীর মগ্নতা লুকিয়ে আছে আলোর অপেক্ষায়। অগত্যা অন্ধকারের জন্য বাধ্য হয়েই ফিরে আসতে হয় সেখান থেকে। আশ্চর্যের বিষয় সব পথেই একই ঘটনা! দিশাহীন...

এখন একটু সাহস ক'রে অন্ধকার হাতড়ে শেষ বাঁক অবধি গিয়ে পড়ি। দেখি এতদিন অগোচরেই ফেলে এসেছি শেষ পথনির্দেশ বোর্ড, যাতে লেখা "সব পথ' এসে মিলে গেল শেষে..."


1 comment:

  1. তোর প্রতিটা লেখায় আমি নিজেকে খুঁজে পাই।।❤❤ অনেক ভালোবাসা তোর জন্য

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত? ঋত্বিক ঘটক :   চলচ্চিত্র তৈরির প্রাথমিক লক্ষ্য মানবজাতির জন্য ভাল কিছু করা। যদি আপ...

পাঠকের পছন্দ