এবারো কলেজের
অ্যানুয়াল পরীক্ষার ফল খুব খারাপ। এত খারাপ যে বলার নয়। ভেবেছিলাম এবার হয়তো উৎরে
যাবো। কিন্তু হলনা। পড়াশুনা করতে যে ভালোই লাগেনা। কফি হাউজের আড্ডার পর হস্টেলের
আড্ডা, গল্পের বই। তারপর পড়াশোনার সময় কোথায়?
গতকাল জলপাইগুড়ি
থেকে এসেছি। শিয়ালদায় নেমে একটা টানা রিক্সায় হস্টেল। সকালে উঠে কলেজের
নোটিসবোর্ডে পরীক্ষার রেজাল্ট। আমার পাশে দাঁড়িয়ে এক বন্ধু বলল, “এবার তাহলে তুই
কী করবি?” আমি অনেকক্ষণ ভেবে জবাব দিলাম, “কী করব ঠিক করে ফেলেছি। তবে তোকে এখন
বলবনা। আমার অন্য একটা রাস্তা খোলাই আছে”।
ঠিক করলাম
রেজাল্টের কথা মা বাবাকে এখন জানাবো না। মাথায় একটা প্ল্যান ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটাকে
শান দিতে আমি গুটিগুটি কফি হাউজের দিকে পা বাড়ালাম। এবার ‘ধী’ পত্রিকায় আমার একটা
কবিতা বেরিয়েছে। কফি হাউজে গেলে পত্রিকাটা হাতে পাওয়া যাবে।
রাত্রে হস্টেলে
ফিরে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। এখনো সব বোর্ডার এসে পৌঁছায়নি। আরো দু দিন পরে নতুন
সেশন শুরু হবে। জুলাই মাস, বাইরে একটা দমকা হাওয়ার সাথে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। একটা
পোস্টকার্ড নিয়ে মাকে লিখলাম “শ্রীচরনেষু মা, আমি ভালোভাবে এসে পৌঁছেছি। তুমি আমার
জন্য চিন্তা কোরোনা। আমি ভালো আছি”। তারিখ ২/৭/৬৫
পরদিন আমার
ট্রাঙ্ক আর হোল্ডঅলটা দেবাশীসের ঘরে রেখে দিয়ে এলাম। দেবাশীসকে বললাম, “আমি
মামাবাড়ি যাচ্ছি। কয়েকদিন পরে এসে এগুলি নিয়ে যাব”। সন্ধ্যাবেলায় হস্টেল থেকে বের হলাম। একটা সতরঞ্চিতে একটা ফোলানো বালিস আর দুটো
চাদর, আর একটা ব্যাগে কিছু জামাকাপড়। এসব নিয়ে এলাম হাওড়া স্টেশনে। কোথায় যাবো ঠিক
করিনি। কিন্তু কেন যেন মনে হল গিরিডি যাই। অনেকদিন আগে একবার গিয়েছিলাম উশ্রী নদীর
ঝর্ণা দেখতে। তখন শীতকাল ছিলো। উশ্রীর ক্ষীণ ধারার দিকে চেয়ে সেবার হতাশ হয়েছিলাম।
এখন এই ভরা বর্ষায় কেমন লাগবে সেই ঝর্ণাটা, ভেবে মধুপুরের টিকিট কাটলাম। মুঘলসরাই
প্যাসেঞ্জার।
থার্ডক্লাস একটা
কম্পার্টমেন্টে উঠে দেখলাম ভীড় নেই। বাঙ্কে উঠে একটা চাদর পেতে শুয়ে পড়লাম। এই
ট্রেনটা সারা রাত চলবে। খুব ভোরে মধুপুরে দাঁড়াবে। সেখান থেকে ট্রেন পালটে গিরিডি।
একবার মানি ব্যাগটা দেখে নিলাম। সাথে কলেজে ভর্তি হওয়ার ত্রিশ টাকা আর হস্টেলের
অ্যানুয়াল ফি বিয়াল্লিশ টাকা আছে। আমার হাত খরচের টাকা থেকে টিকিট কেটে আর এগারো
টাকা পড়ে আছে। চলে যাবে কিছু দিন।
খুব ভোরে মধুপুরে
আসার কিছু আগেই ঘুম ভেঙে গেল। বাঙ্ক থেকে নীচে নামতেই
দেখলাম আমার জুতোজোড়া গায়েব। নতুন জুতো নয়। কিন্তু আমার তো ওই এক জোড়াই সম্বল।
কাঁকর বিছানো প্ল্যাটফর্মে নেমে টের পেলাম পৃথিবীর মাটির পরশ কতটা কঠিন । একলা পথে বেরিয়ে পদে পদে কী অবস্থার সম্মুখীন হব তার একটু আভাসও পেলাম।
মধুপুরে স্টেশন
থেকে বেরিয়ে প্রথমেই একটা জুতো কিনতে হবে। কিন্তু দোকান খোলেনি। দোকান খোলা
পর্যন্ত অপেক্ষা করতে গেলে গিরিডির ট্রেন ধরা যাবেনা। কিন্তু জুতোটাই আগে দরকার।
গিরিডি যাওয়ার আশা ত্যাগ করে জুতোর দোকান খোলার আশায় বসে রইলাম একটা চায়ের দোকানে।
দশ পয়সার চা আর দশ পয়সার বিস্কুট দিয়ে মধুপুরের সকাল শুরু হল। মধুপুর নিতান্তই ছোট গঞ্জ একটা। দোকানপাট বেশি নেই। দশটায় দোকান খুললো। জুতোর
দোকান কলকাতার ফুটপাথের দোকানের থেকে কিছু উৎকৃষ্ট নয়। চামড়ার জুতো যেগুলি আছে,
পায়ে দিয়ে বুঝলাম ওগুলো পরলে হাঁটার আশা ত্যাগ করতে হবে। দামও যথেষ্ট বেশি। অনেক
ভেবে চিনতে একটা রবারের পাম্পশু কিনে নিলাম। দাম পড়ল আড়াই টাকা।
গিরিডি যাওয়া
হলনা। মধুপুর স্টেশনেই এসে আশ্রয় নিলাম। প্ল্যাটফর্মের কলে স্নান সেরে
নিলাম। রাত্রে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে শুয়ে ঘুম দিলাম। এবার জুতোটা মাথার নীচে নিয়ে
শুলাম। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম প্ল্যাটফর্মে আপ মুঘলসরাই প্যাসেঞ্জার এসে
দাঁড়িয়েছে। একটা থার্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্ট খালি দেখে তাতে উঠে বসলাম। টিকিট
কাটিনি, ঠিক করলাম যেখানে চেকার নামিয়ে দেবে সেখানে নেমে যাব। পরের স্টেশন যশিডি,
স্টেশনের বাইরে লেখা আছে দেওঘর যাওয়ার জন্য এখানে গাড়ি বদল করতে হয়। নেমে পড়লাম।
স্টেশনে নামতেই
এক পান্ডার খপ্পরে পড়ে গেলাম। বিহারী পান্ডা, কিন্তু বেশ
বাংলা বলে। আমাকে ছিনে জোঁকের মত আঁকড়ে ধরল। আমার এমনিতে খুব একটা ভক্তি টক্তি
ছিলনা। কিন্তু অচেনা জায়গায় এদের এড়াতে গেলে বিপদ হতে পারে ভেবে তার সাথে দর
কষাকষি শুরু করে দিলাম। অবশেষে ঠিক হল এক রাত থাকা, দু বেলা খাবার আর মন্দির দর্শন
বাবদ পাঁচ টাকা আট আনা দিতে হবে। শ্রাবণ মাস পড়তে কয়েকদিন দেরি আছে। সিজন শুরু
হয়নি। তাই সস্তায় হল বলে মনে হল। পান্ডা বাবাজী আমাকে ট্রেনে বসিয়ে নিজে পাশে বসে
রইল যাতে আমি কেটে না পড়ি।
মন্দির দর্শন করে
দুপুরে ডাল আর কি একটা ভাজি দিয়ে ভাত খেলাম পান্ডার বাড়িতে। তার বাড়ির পাশেই একটা
ধরমশালা দেখিয়ে দিয়ে বলল, “ওখানে চলে যান, রাত্রে থাকার জায়গা হয়ে যাবে”। ধরমশালা
দেখে একটু ভক্তি হল। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। এক একটা ঘরে তিনটে চারটে করে খাটিয়া
পাতা। ম্যানেজার আমাকে একটা খাটিয়া দেখিয়ে দিয়ে বলল, “এটা আপনার খাটিয়া। দামি জিনিস
অফিসে জমা রাখতে পারেন। ভয় নেই চুরি হবেনা”। আমার পাশের খাটে এক বিহারী বুড়ো মানুষ
আমাকে দেখে গল্প জুড়ে দিলো, “কাঁহাসে আয়ো, কলকাত্তা সে? ঘর ছোড়কে আয়ো কা?” আমি
দেখলাম এর সাথে গল্প করার চাইতে এক ফাঁকে ত্রিকূট পাহাড়টা দেখে আসতে পারলে ভালো
হয়।
এমনিতেই পাহাড় আমাকে
খুব টানে। তার উপরে ত্রিকূট পাহাড় ফাঁকা মাঠের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছে দেখে মুগ্ধ
হয়ে গেলাম। আমি এসেছি একটা সাইকেল ভাড়া করে ঘন্টায় চার আনা দরে। উঁচু নীচু পথে
চালাতে বেশ কষ্ট হয়েছে। তার উপরে প্রচন্ড গরম। তবু ভালো লাগল। ফিরতে একটু রাতই হল।
ক্লান্ত হয়ে ধরমশালায় ফিরে দেখি পান্ডা বসে আছে। ওর পাওনা আমি আগেই মিটিয়ে
দিয়েছিলাম। আমাকে দেখে বলল, “রাতে আমার বাড়িতে খাবেন। এখন যাবেন কি?” আমি ভুলেই
গিয়েছিলাম ওর সাথে আজ দুবেলা খাওয়ার কনট্র্যাক্ট হয়েছিল।
দেওঘরে আর থাকার
কোনো মানে হয়না। কিছুই দেখার নেই। ঠিক করলাম পরদিন সন্ধ্যার ট্রেনে চলে যাব। টাইম
টেবিলে দেখলাম এখান থেকে বক্তিয়ারপুর গিয়ে গাড়ি বদল করে রাজগীর যাওয়া যায়। পথে
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের রুইন্স পড়বে। ঠিক করলাম বাড়ি থেকে যখন
বেরিয়ে পড়েছি, এগুলি দেখেই নেওয়া যাক।
আমার এই বেরিয়ে
পড়াটা যে এক রকম বাড়ি থেকে পালানো তাতে আর কোনো সন্দেহই নেই। আমি পালাচ্ছি, কারণ
পরীক্ষার এই রেজাল্টের পরে কারো কাছে আর মুখ দেখাবোনা বলে। আমি পালাচ্ছি কারণ আমি
আমার ভাগ্য নিজেই খুঁজে নেব বলে। এছাড়াও এই পালানোর পিছনে এক ভবঘুরে বিশ্বনাগরিক পন্ডিতের
প্রচ্ছন্ন হাতও আছে। কয়েকদিন আগে তাঁর একটি বইয়ে পড়েছিলাম, তিনি লিখেছেন, সতের
আঠের বছর বয়সটা নাকি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার শ্রেষ্ট সময়। মা কাঁদবে, বাবা রাগ করবে,
কিন্তু এসব দেখতে গেলে ভবঘুরে হওয়া যায়না। সেরা ভবঘুরে সেই হতে পারে যে এসব নিয়ে
মাথা ঘামায় না। ভেবে দেখলাম, হয়তো ভবঘুরে হওয়াটাই আমার একমাত্র ডেস্টিনি। দেখা যাক
কদ্দুর যেতে পারি।
যশিডিতে
বক্তিয়ারপুরগামী ট্রেনের একটা থার্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টের বেঞ্চিতে আমার মালগুলি
রেখে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় দেখি একটি দেহাতি মেয়ে একটা কালোমতন
উদোম ন্যাংটা শিশু আমার কোলে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “ভাইয়া থোরা পাকরো”। বলে ভীড়ের মধ্যে
কোথায় মিলিয়ে গেল। আমি তো মনে মনে প্রমাদ গুনছি। কয়েক মিনিট পরে দেখি মেয়েটা ফিরে আসছে। সাথে একগাদা পোটলা পুটলি, একটি যুবক আর
দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধা। সবাইকে ঠেলে ঠুলে গাড়িতে তুলে দিয়ে একগাল হেসে আমার কোল থেকে
বাচ্চাটা নিয়ে নিল। মেয়েটার বয়স খুব বেশি হলে সতের আঠেরো হবে। আমারি বয়সী। আমাকে
বলল, “অন্দর আকে বৈঠ ভাইয়া, টিরেন ছুট যায়ী।”
ট্রেন ছাড়তেই পুঁটলি
থেকে রুটি আর আচার বের করে সবাইকে দিল। আমাকেও। আমি প্রথমে একটু না না করে নিয়েই
নিলাম। মেয়েটিকে দেখলাম খুব সপ্রতিভ। হেসে হেসে কথা বলছে সবার সাথে। এর ফাঁকেই
আঁচল সরিয়ে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আমি কোথায় যাব। বললাম ঠিক
নেই, রাজগীর যাওয়ার ইচ্ছা আছে। শুনে মেয়েটা বলল, “তাহলে তো ভালই হল। আমরাও ওদিকে যাব, পাওয়াপুরী।
বক্তিয়ারপুর থেকে এক সাথেই যাওয়া যাবে”। মেয়েটির সাথে রয়েছে বাইশ তেইশ বছর বয়সী স্বামী আর শ্বশুর
শাশুড়ি। তীর্থ সেরে ফিরছে।
বক্তিয়ারপুর
স্টেশনে নেমে মেয়েটি আমাকে ধরে বসল, ভাইয়া তোমার যখন কোথাও যাওয়ার ঠিক নেই, তাহলে
আমাদের সাথে চলো। আমাদের গ্রামে। ওখান থেকেই রাজগীর ঘুরে আসতে পারবে। আমাদের গরুর
গাড়ি আছে, সাইকেল আছে তুমি তাতে করেই নালন্দা যেতে পারবে। আমি ভেবে দেখলাম, মন্দ
কি। আমার দুদিন একটা থাকার জায়গা হয়ে যাবে।
পাওয়াপুরি রোড স্টেশনে
নেমে দেখলাম ওদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুটো গরুর গাড়ি এসেছে। বোঝা গেল বেশ সম্পন্ন গৃহস্থ ওরা। মেয়েটি শ্বশুর শাশুড়ির সাথে একটা গাড়িতে উঠল, মেয়েটির স্বামী আর আমি উঠলাম আর একটা গাড়িতে
মালপত্র সমেত। স্টেশন থেকে
তিন চার কিলোমিটার দূরে ওদের গ্রাম। সকলেরই মাটির বাড়ি খাপড়ার চাল। এখানে প্যান্ট সার্ট পরা লোক বোধ হয় বিশেষ আসেনা। তাই আমাকে
দেখার জন্য ভীড় জমে গেল। সবাই কথা বলছে, কিন্তু আমি কারো কথাই বুঝতে পারছিনা। ভাষাটা হিন্দী হলেও কিরকম একটা টান আছে। একটু পরে মেয়েটি এসে “হটো হটো” বলে
সবাইকে হাটিয়ে দিল। মেয়েটির নাম বলতে পারবনা। আসলে কারো
মুখেই মেয়েটির নাম শুনতে পাইনি। শ্বশুরের নাম রাজু যাদব। লোকটা দেখলাম পুত্রবধূকে
বেশ সমীহ করে। বস্তুতঃ মেয়েটির কথাই সকলে শুনে চলে। কথায় কথায় জানতে পারলাম মেয়েটি
নাকি লেখাপড়া জানে। স্কুলে পড়েছে। পোস্ট কার্ডে চিঠিও লিখতে পারে।
এই গ্রামে এসে
আমার সত্যিকারের ভারতদর্শন শুরু হল। এরকম
গ্রাম আগে দেখা থাকলেও কোনদিন বাস করব ভাবিনি। গ্রামে দশ পনেরোটা পরিবার থাকে।
গ্রাম ঘিরে বিস্তীর্ণ ভুট্টার খেত। কিছু জমিতে সদ্য লাঙল পড়েছে। ধানের রোয়া বসবে।
আকাশ মেঘলা। দিগন্তে একসারি পাহাড় দেখা যাচ্ছে।
দুপুরে সবাই
একসাথে মাটিতে বসে খেলাম। কাঁসার থালায় ভাত, একটা সবজি আর আচার। মেয়েটি খুব কুন্ঠিত
হয়ে বলল, এবেলা ভালো করে খাওয়াতে পারলামনা। তাই ভাইয়া কিছুই খেলেনা।
খেয়ে উঠে একটা
সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম নালন্দা বিহার দেখতে। খুব দূরে নয়। দু কিলোমিটারের মত।
শুনশান মাঠের মাঝখানে বিরাট একটা ধ্বংসস্তুপ। ইতিহাস বইয়ে যেরকম ছবি দেখেছি, হুবহু
সেরকম। বাইরে একটা বিশাল বোর্ডে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা আছে, হিন্দি আর ইংরাজিতে।
এখানে আমার মন্দ
লাগলনা। কিন্তু আমি তো থাকার জন্য আসিনি। ঠিক করলাম কাল সকালেই
এখান থেকে চলে যাব। প্রথমে রাজগীর, তারপর দেখা যাবে কোথায় যাই। রাত্রে ঘরের বাইরে
উঠানে খাটিয়া পেতে ঘুমের ব্যবস্থা হল। রাত্রে বৃষ্টি হলে খাটিয়া সমেত ঘরে ঢুকে
যেতে হবে। কিন্তু বৃষ্টি হলনা। সকালে হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখি
মেয়েটার স্বামী একটা সাইকেল নিয়ে এসেছে। আমাকে বলল, “ইস সাইকলসে বস স্ট্যান্ড তক
ছোড় দেব।” মেয়েটা একটা পোটলায় রুটি আর আচার বেঁধে দিল। খুব ভোরে উঠে ও আমার জন্য
রুটি বানিয়েছে। আমার মনটা কেমন যেন নরম হয়ে গেল। মেয়েটাকে দিদি বলে ডেকেই ফেললাম।
রাজগীরে গিয়ে প্রচন্ড
গরমে ভালো করে ঘোরাই হলনা। সপ্তপর্ণী গুহা যেতে পারলামনা। উষ্ণ প্রস্রবণের কাছে
গিয়ে কোন রকমে জলে হাত ছুঁইয়ে পালিয়ে এলাম। এখানে বিম্বিসারের প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ
আছে। বিম্বিসার নামটা শুনলেই রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে। ঠিক করলাম এখানে আজ রাত
কাটিয়ে কাল ভোরে গয়া যাব। এখান থেকে সরাসরি গয়ার বাস আছে। কতদিন পথে পথে ঘুরতে হবে
কে জানে। একটা কাজও খুঁজতে হবে। শুধু দেশ দেখলে তো চলবেনা, নিজের পায়ে দাঁড়াতে
হবে।
নিজের পায়ে
দাঁড়ানো যে কী ব্যাপার তা এখন পর্যন্ত মাথায় আসেনি। কলেজে পড়ার সময় হস্টেলে থেকেছি। প্রতি মাসে বাড়ি থেকে মানি অর্ডারে টাকা এসেছে। তাই দিয়ে সব খরচ মিটিয়ে সিনেমা
দেখেছি, আড্ডা মেরেছি, কফি হাউজে কফি খেয়েছি। এখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে টাকা উপার্জনের কথা ভাবার সময় এসেছে। এখন পর্যন্ত
কাজের চেষ্টা করিনি। আর এসব জায়গায় কাজ কোথায়? আমিই বা কী কাজ জানি যে করতে পারব?
টিউশনি করতে পারি, কিন্তু তাই বা দেবে কে?
রাত্রে থাকার
জন্য গেলাম একটা হোটেলে। হোটেল সপ্তপর্ণী, ঘর ভাড়া আট টাকা, বাপরে! এত টাকা দিয়ে
থাকা সম্ভব না। এই সব ভাবতে ভাবতে সস্তার হোটেলের খোঁজ করতে থাকলাম। অনেক ঘুরে সস্তার
হোটেল একটা খুঁজে বার করলাম। তাও চার টাকা বেরিয়ে গেল।
রাতের খাওয়া সারলাম রাস্তার এক পাইস হোটেলে। আট আনায় ঢেঁড়স ভাজা, ডাল আর ভাত।
পরদিন গয়া। বাসে
আসতে চার ঘন্টা লেগেছে। ধুলায় ভরা উঁচু নীচু পথ। মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাহাড় দেখা
যায়। একটা নদী পার হলাম। শুনলাম ওটা ফল্গু নদী। বেশিরভাগটাই বালু। মাঝে মাঝে জল আছে। গয়া শহরটা বেশ ঘিঞ্জি, অনেকটা আমাদের বড়বাজারের মত। বাস
আমাকে নামিয়ে দিলো স্টেশনের কাছে একটা রাস্তার উপরে। সে রাস্তাও খুব একটা চওড়া নয়। বেশ ভীড়, তার উপর গরু শুয়ে আছে। রাস্তা দিয়ে
টাঙ্গা চলছে। রাস্তার পাশেই একটা
মন্দিরের লাগোয়া একটা ধর্মশালা পেয়ে গেলাম। মারোয়াড়ি ধর্মশালা। সেখানে থাকার
জায়গাও পেয়ে গেলাম। ধর্মশালার ভিতরের দিকে একটা চাতাল। সেখানে একটা চৌবাচ্চা।
সেটাকে ঘিরে কয়েকজন স্নান করছে। এক কোনায় দু তিনটে পায়খানা।
সার্ভিস ল্যাট্রিন। আমিও জামাকাপড় ছেড়ে স্নান সেরে নিলাম। জামাকাপড় ধুয়ে মেলে
দিলাম।
রাস্তার উল্টো
দিকে একটা পাইস হোটেল আর তার পাশে সিনেমা হল। দিলীপকুমারের সিনেমা চলছে। সিনেমার
নাম বাবুল। অনেক পুরোনো সাদা কালো সিনেমা। আমার আবার এসব সিনেমা দেখতে খুব ভালো
লাগে। টিকিট সেকেন্ড ক্লাস চল্লিশ পয়সা। সিনেমা দেখে ধরমশালায় ফিরে এসে দেখি নতুন
একটা পরিবার এসেছে। বাঙ্গালী। বাবা মা আর একটি মেয়ে। মেয়েটির বয়স পনেরো ষোল হবে।
বাঙ্গালী বলেই
আলাপ করলাম। মনে হল প্রবাসে এসে একজন বাঙ্গালীকে পেয়ে ওরা খুব খুশি। ওরা এসেছে
পিন্ড দিতে। স্টেশন থেকেই ওদের সাথে একজন পান্ডা এসেছে। আসলে পান্ডাই ওদেরকে স্টেশন থেকে ধরে এনেছে। পান্ডা
আমাকেও ধরে বসল, পিন্ড দিতে হবে। আমি বললাম আমার তো বাবা বেঁচে আছে। আমি কেন
পিন্ডি দিতে যাবো। সে বলল, সাত পুরুষ পর্যন্ত পিন্ডি দিতে পারা যায়। গয়ায় পিন্ডি
দিলে তাঁরা মুক্তি পেয়ে যাবেন। আমি পান্ডাকে এড়াবার ফিকির খুঁজতে লাগলাম। শেষে
বলেই ফেললাম, যতদিন আমার বাবা বেঁচে আছেন আমি কাউকে পিন্ডি দেবনা। পান্ডা দেখলাম
এই কথার উপর আর কথা বললনা। আমিও ওই বাঙ্গালী পরিবারের সাথে ভিড়ে গেলাম।
পরদিন সকালে উঠেই
একটা টাঙ্গা ভাড়া করে ওরা চলল পিন্ডি দিতে। আমিও উঠলাম সেই টাঙ্গায়। গয়ায় ফল্গু
নদীর তীরে বিষ্ণুপাদ মন্দির। নদীর ধারে একপাশে কাটা
চুলের স্তুপ। আর একদিকে পচা ফুল আর বেলপাতা ডাঁই করা আছে। যেখানে বিষ্ণুর পায়ের
ছাপ আছে, আগে সেখানে গিয়ে পূজা দিয়ে তারপর পিন্ডি দিতে হয়। ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা মন্দিরে
ঢুকে গেলেন। আমি আর মেয়েটি বসে রইলাম মন্দিরের বাইরে সিঁড়িতে। মেয়েদের সাথে
মেলামেশায় আমার বেশ একটু কুন্ঠা আছে। তার কারণ হয়তো ছেলেদের স্কুলে পড়েছি বলে।
কলেজে কো এডুকেশন। কিন্তু ক্লাসে ছেলেরা আর মেয়েরা আলাদা জায়গায় বসে। মেয়েরা
বেশিরভাগই পড়াশোনায় ভালো আর খুব গম্ভীর গোছের। মেলামেশার সুযোগ কিছুটা
থাকলেও আমার গায়ের মফস্বলের গন্ধ আমাকেই তাড়া করে দূরে সরিয়ে রাখে। মনে মনে হয়তো
কারো প্রেমে পড়ে যাই। কিন্তু বাস্তবে কিছুই ঘটেনা।
এই মেয়েটি কিন্তু সহজেই আমার সাথে আলাপ করল। মেয়েটি থাকে কৃষ্ণনগরে, ক্লাস টেনে পড়ে সাইন্স
নিয়ে। খুব গল্পের বই পড়ে, আর উত্তমকুমারে ফ্যান। আমি আবার সৌমিত্রের ফ্যান। আমাদের
কিছুক্ষণ তর্ক হল এই নিয়ে।
পিন্ডি দিয়ে ফিরে এসে দেখলাম ভদ্রলোকের মুখ খুব গম্ভীর।
বললেন, “পান্ডা ব্যাটা মোচড় দিয়ে অনেক টাকা নিয়ে নিল। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে গেলে
অনেক কম পয়সায় হত”। দুপুর বেলায় আমরা একটা বাঙ্গালী হোটেলে
খেলাম। ওরাই খাওয়ালো। আমার গল্প শুনে (যদিও বেশ
কিছুটা বানানো) ভদ্রমহিলা বললেন, “এই বয়সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লে। সাবধানে থেকো। গয়া
এমনিতে বড় শহর, এখানেই একটা কাজ খুঁজে নাও”।
রাত্রের ট্রেনে
ওরা ফিরে গেলেন। আমি গয়াতেই থেকে গেলাম। বুদ্ধগয়া দেখা বাকি আছে। পরদিন একটা
সাইকেল ভাড়া করে রওনা হলাম বুদ্ধ গয়ার পথে। ফল্গুর ধার ধরে রাস্তা। ফল্গুতে
বেশিরভাগই বালুর চড়া। মাঝে মাঝে ক্ষীণ জলের ধারা দেখা যাচ্ছে। প্রায় এগারো
কিলোমিটার পথ। একবার সাইকেল থেকে নেমে নদীর জলে মাথা ভিজিয়ে নিলাম। একটা টুপি পরে
আসা উচিত ছিল। কিন্তু টুপির জন্য পয়সা খরচ করা চলবেনা। হাতের পুঁজি ক্রমশঃই ফুরিয়ে
আসছে। এবার একটা কাজ খুঁজে নিতেই হবে।
বুদ্ধগয়ায় গিয়ে
বৌদ্ধ মন্দির, প্যাগোডা ইত্যাদি দেখে বোধি বৃক্ষের সামনে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। এটা
মূল গাছটা নয়। তার চারা থেকে জন্ম নিয়েছে। কিন্তু এখানেই বুদ্ধ নির্বান লাভ
করেছিলেন। ভগবান বুদ্ধের সাথে আমার পরিচয় অবনীন্দ্রনাথের নালকের গল্পের মাধ্যমে। গৌতমবুদ্ধকে
চিরকাল মনে হয়েছে রূপকথার নায়কের মত। একজন সন্ধানী বিশ্বপথিক পরিব্রাজক। নালকের কাহিনির শেষ লাইনে আছে এক বৃদ্ধ বাউল গান গাইছে “এরে ভিখারী সাজায়ে কী
রংগ করিলে”। আমার ভাগ্যেও কী জানি কী আছে। আমাকেও কি শেষে ভিখারী হতে
হবে?
গয়াতে কাজকর্মের
একটু খোঁজ করলাম। বিশেষ কিছু সাড়া পেলাম না। একজন বলল, “শোনপুরে চলে যাও, ওখানে
অনেক কলকারখানা আছে। কাজ জুটে যাবে”। ঠিক করলাম শোনপুর নয় ডিহিরি
অন শোন এ প্রথমে যাবো। শোনপুরে শীতকালে হরিহরছত্রের মেলা বসে। ওটা অন্য একবার
দেখতে যাব।
রাত্রে
প্যাসেঞ্জার ট্রেনে যাওয়াই ভালো। ভাড়া কম আর রাত্রে থাকার জায়গার চিন্তা করতে
হয়না। স্টেশনে চার আনার পুরি তরকারিতে বেশ পেট ভরে যায়। হিসাব করে দেখলাম কলকাতা ছাড়ার পর এগারো দিন কেটে গেছে। হাতে আর বত্রিশ টাকা
কয়েক পয়সা আছে। এটার উপর আর ভরসা করা যায়না। কাজ একটা পেতেই হবে।
শোন নদীর উপর লম্বা রেলব্রিজ। তার উপর দিয়ে
ট্রেনটা ধীরে ধীরে পার হল। এখানে শোন নদী বিশাল চওড়া। ডিহিরি অন শোন স্টেশনে নেমে
একটা রিক্সাওলাকে জিজ্ঞাসা করলাম ধারে কাছে কোন ধর্মশালা আছে? সে বলল,”আঠ আন্না
লাগেগা।” আট আনা মানে অনেক। ভাবলাম বেশ দূরেই হবে। রিক্সায় উঠলাম। রিক্সাওলা একটা
মোড় ঘুরেই একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড় করালো। এত কাছে, তাও আট আনা নিয়ে নিলো!
বাড়িটা একতলা, সামনে উঠান, তাতে কয়েকটা খাটিয়া পাতা। একটা খাটিয়ায় বছর চল্লিশেকের
এক ভদ্রলোক বসে আছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হিন্দীতেই, “এটা কি ধর্মশালা?” সে বলল, “নেহি
ভাই, কিরায়াশালা হ্যায়। দিন এক রুপিয়া লাগেগা। লেকিন আচ্ছা জায়গা হ্যায়”।
‘আচ্ছা জায়গা’
যখন তখন দেখাই যাক। আমি রিক্সা থেকে নেমে ভিতরে গেলাম। একটা অফিস ঘর আছে। সেখানে
নাম ধাম লেখাতে হল। সেই বছর চল্লিশেকের ভদ্রলোক যেচে এসে আমার সাথে আলাপ করল। নাম
শিউ কুমার শুক্লা। বাড়ি ফারুখাবাদ। একটা কাপড় কম্পানির কমিশন এজেন্ট। লোকটা আমাকে
দুপুরে ওর সাথে খাওয়ার জন্য নেমন্তন্ন করল। দুপুর একটা নাগাদ আমাকে নিয়ে গেল একটা
হোটেলে, নাম মাড়োয়াড়ী বাসা। এখানে মাত্র দেড় টাকায় পেটচুক্তি খাওয়া যায়। নিরামিষ
কিন্তু খুব সুস্বাদু খাবার। তিন চার রকমের তরকারি, ডাল, ঘি মাখানো রুটি, ভাত, দই,
আচার। শিউকুমার শুক্লা প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে খেলো। আমি ওর খাওয়া দেখে অবাক,
এত খেতে পারে একটা মানুষ?
লোকটা বলল, “আমি
এই এক বেলাই খাই। দেড় টাকায় যতটা পারি উসুল করে নিই। সারা দিনে তিন টাকার বেশি খরচ
করিনা।”
ধর্মশালায় ফিরে
শিউকুমার শুক্লার কাছে আমার মনের ভাব প্রকাশ করে ফেললাম। একটা কাজ যদি জুটিয়ে দিতে
পারে। লোকটা বলল, “বেশ, আমার সাথেই কাজ করতে পারবে। আমারো একটা অ্যাসিস্ট্যান্ট
দরকার। দোকানে দোকানে ঘুরে কাজ করতে হবে। স্যাম্পল দেখিয়ে অর্ডার নিতে হবে।
কয়েকদিন আমার সাথেই থাকো। পরে কাজ শিখলে আলাদা কাজ করবে, কমিশন পাবে। এখন দিনে
তিনটাকা করে দেবো”।
সন্ধ্যা বেলায়
শুক্লাজী, এই নামেই লোকটা আমাকে ডাকতে বলেছে, আমার ট্রেনিং শুরু করল। একটা ঢাউস
ব্যাগ খুলে কার্ডবোর্ডের গায়ে লাগানো টুকরো টুকরো ছাপা কাপড় বের করে দেখালো।
এগুলিই স্যাম্পেল। কার্ডবোর্ডের পিছনে দাম লেখা আছে। কীভাবে দোকানদারের কাছে
কাপড়গুলি দেখাতে হবে তা বুঝিয়ে দিল। দোকানে খদ্দেরের ভীড় থাকলে কীরকম ব্যবহার করতে
হবে তার একটা পাঠ দিলো। এই সব কাপড় সুরাট আর আমেদাবাদ থেকে আসে। নাম বম্বে
প্রিন্টের কাপড়।
এর পর একটা
হিসাবের খাতা বের করল। হিন্দীতে লেখা খাতা। আমি একটু একটু পড়তে পারি। খাতাটা
দেখিয়ে বলল, “আগের বারে যারা অর্ডার দিয়েছিল তাদের হিসাব এখানে রাখা আছে। আমি
কিন্তু বিক্রি করিনা। বিক্রি করে “ওমপ্রকাশ বিনোদকুমার” নামে ফারুখাবাদের এক
ফার্ম। অর্ডার অনুসারে ওরা সরাসরি দোকানগুলিকে কাপড় পাঠায়। টাকা আদায় ওরাই করে।
আমাকে শুধু বিক্রির উপর কমিশন দেয়”। অর্ডার বইয়ে কী করে অর্ডার
নিতে হয় তাও দেখিয়ে দিল।
পরদিন সকালে দুটো
কাপড়ের গাঁঠরি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। রিক্সা করে। গন্তব্য ডালমিয়ানগর।
ডালমিয়ানগর বেশ সাজানো শহর। চওড়া রাস্তা। বড় বড় দোকান। এখানে ডালমিয়াদের অনেক
কারখানা আছে, যা ঘিরে একটা বড় শহর গড়ে উঠেছে। রোটাস ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড লেখা বড়
বড় বিজ্ঞাপন রয়েছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে।
অন্যের বোঝা ঘাড়ে
করে ঘোরার অভিজ্ঞতা আমার সেই প্রথম। মনটায় একটু স্বস্তি বোধ হচ্ছে। যাহোক একটা কাজ
তো জুটলো। মাসে সত্তর আশি টাকা জুটবে। তার উপরে যদি কিছু কমিশন পাই তো চলেই যাবে।
প্রথম দোকানে ঢুকে
দেখলাম একজন খদ্দের রয়েছে। মাড়য়াড়ীর গদি। তার এক কোণায় গিয়ে বসে গাঁঠরি খুলে একে
একে স্যাম্পেল বের করলাম। দোকানদার, দেখলাম, শুক্লাজীকে চেনে। দুজনেই দুজনের
খোঁজখবর নিলো। আমাকে দেখে বলল, “ইয়ে বঙ্গালী লেড়কা কাঁহাসে মিলা?” প্রশ্নটার মধ্যে
এমন একটা তাচ্ছিল্যে সুর যে আমার মনটা খিঁচড়ে গেল। আমার দিকে ফিরে বলল, “হিন্দী বোলনা আতা হ্যায়?”
আমি ঘাড় নাড়লাম। প্রচুর হিন্দী সিনেমা দেখার সুবাদে অল্পস্বল্প তো বলতেই পারি।
পড়তেও পারি।
খদ্দের চলে গেলে
শুক্লাজী আমাকে ইশারায় বলল, স্যাম্পেল দেখাও। আমি একটা একটা করে দেখাতে থাকলাম, আর
দাম বলতে থাকলাম। প্রত্যেকটা স্যাম্পেলের আলাদা আলাদা নাম আছে, যেমন ‘লাল ফুল,
বুটিদার’, সাথে সুতার কাউন্ট লেখা আছে। দোকানদার সব কটা স্যাম্পেল ভালো করে পরখ
করল। তারপর অর্ডার দিলো। প্রায় দেড়শো
টাকার অর্ডার হল।
আরো ছসাতটা দোকান
ঘুরে মোট ছশো টাকার অর্ডার পাওয়া গেল। শুক্লাজীকে দেখে মনে হল খুশি। আমাকে বলল, “আজকের
মত কাজ শেষ। এবার চল, স্নান করে খেতে যাব। আজ আমি খাওয়াব না। তোমাকে নিজের পয়সায়
খেতে হবে”।
দুদিন পরে ডিহিরি
অন শোনের পাট উঠিয়ে ট্রেনে চাপলাম। এবার গন্তব্য গাড়োয়া। শিউকুমার শুক্লার সাথেই চলেছি
পালামৌ জেলায় একটা মফঃসল শহরে। পালামৌ নাম শুনেই মনটা নেচে
উঠল। সঞ্জীবচন্দ্রের পালামৌ পড়া আছে। আমার কল্পনায় পাহাড় আর অরণ্যঘেরা এক জনপদের
ছবি ফুটে উঠল।
বাস্তব চিত্রটা
একেবারেই অন্যরকম। ট্রেন থেকে নামলাম গাড়োয়া রোড নামে একটা স্টেশনে। ছোট্ট কিন্তু
বেশ ব্যাস্ত স্টেশন। অত্যন্ত নোংরা। স্টেশন ঘিরে গিঞ্জি বস্তি। এখান থেকে বাসে করে
গাড়োয়া যেতে হবে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বাস আমাদেরকে একটা নদীর ব্রিজের এপারে নামিয়ে
দিলো। বলল, হেঁটে ব্রিজ পার হয়ে আবার বাসে উঠতে হবে। কারণ হল, ভর্তি বাসে টোল লাগবে চার টাকা আর
খালি বাসের এক টাকা। নদীর নাম কোয়েল। এত সুন্দর নামের একটা নদী অন্ধকারের জন্য
ভালো করে দেখাই হলনা।
গাড়োয়া বাস
স্ট্যান্ডে নেমে একটা টাঙ্গা নিয়ে এলাম একটা ধর্মশালায়। ছোট্ট শহর, থাকার জায়গা
বলতে ধর্মশালাই সম্বল। এই ধর্মশালাটা একতলা, ইঁটের দেয়াল আর খাপড়ার চাল। মাঝখানে
একটা চৌকো চাতাল, সেটা ঘিরে বারান্দা। বারান্দা ঘিরে ঘরগুলি। সামনের উঠোন থেকে
একটা ঘরের ভিতর দিয়ে বারান্দায় পৌঁছাতে হয়। বারান্দা থেকে ঘরে যেতে হয়। আমি যে
ঘরটা পেলাম সেটাতে একটা কাঠের চৌকি আর একটা টেবিল আছে। ঘরে আর একটা দরজা আছে, তা
দিয়ে বাইরে একটা বাগানে যাওয়া যায়।
বারান্দার এক
কোণে একটা আসন পাতা তার উপরে লাল উড়ূনি আর লাল লুঙ্গি পড়া একটি লোক বসে আছে। কপালে
সিঁদুরের টিপ। দেখে সাধুবাবা বলে মনে হল। আমাদের দেখে সে আইয়ে আইয়ে বলে অভ্যর্থনা
করল। শিউকুমার শুক্লা তার হাঁটুতে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল। আমার আবার অত ভক্তি
আসেনা। আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখে সাধু মন্তব্য করল, “বাঙ্গালীলোগ নাস্তিক হোতা হ্যায়।”
ধর্মশালায় অতিথি
বলতে আমরা দুই জন। বাকি লোকেরা সাধুর দর্শনার্থী। তাদের মধ্যে কয়জন মহিলাও দেখলাম। তারা সাধুর দিকে মুখ করে বারান্দায় বসে আছে
আর বচন শুনছে। মাঝের চাতালে বৃষ্টির জল জমে আছে। পানের পিকে সেই জল রক্তবর্ণ ধারণ
করেছে। দেখে গা গুলিয়ে উঠল। আমার নিজের অবস্থাও কিছু ভালো নয়। জামা কাপড়ের হাল খুব
খারাপ। ভালোমতন দাড়ি গোঁপ গজায়নি বলে রক্ষা। গায়ের কালো রঙের উপর
আরো এক পোঁচ কালি পড়েছে। ইস্তিরিবিহীন প্যান্ট সার্ট। তিনটে
সার্ট পালা করে কেচে পরি। পায়ে রবারের জুতো।
ক্রমে সাধুর
পরিচয় পেলাম। নাম দীন দয়াল শর্মা। পূর্বাশ্রমের নামই বহাল রেখেছে। ইনি পরিব্রাজক,
কোনো স্থায়ী আখড়া নেই। মাঝে মাঝে এই ধর্মশালায় এসে ওঠে। দু চার মাস কাটিয়ে আবার
চলে যায়। ইনি আবার দিল্লীর
এক বড় নেতার আত্মীয়।
ধর্মশালার দেখভাল
করে এক অল্পবয়সী ছোকরা। সকলের ফাই ফরমাশও খাটে। সে আমাদের জন্য রাত্রের খাবার পুরি
তরকারি এনে দিলো। খাবার খেয়ে আমিও আমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘরের ভিতর একটা
মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। সেটা নিবাতেই জানলা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে এসে পড়ল।
অচেনা যায়গা, তার উপরে নোংরা। আমার অনেকক্ষণ ঘুমই এলোনা। বার বার মার কথা মনে পড়তে
লাগল। মাকে চিঠি লিখিনি কতদিন। সবাই নিশ্চয়ই এতদিনে জেনে গেছে আমি নিরুদ্দেশ। কী
করছে কে জানে। পুলিশে খবর দিয়েছে কিনা কে জানে। ঠিক করলাম কাল সকালে উঠেই মাকে
একটা চিঠি দিয়ে সব জানিয়ে দেবো।
পরদিন সকালে উঠে
কাজে বের হলাম। এটা একটা মহকুমা শহর। বাজার, হাসপাতাল সবই আছে। পাথুরে জায়গা।
রাস্তার ধারে ধারে ঝোপ ঝাড় রয়েছে। বাজারে গিয়ে দেখলাম কাটা কাপড়ের অনেকগুলি দোকান।
কিছু অর্ডার পাওয়া গেল। এখানে এসে যেটা লক্ষ্য করলাম তা হল শিউ কুমার শুক্লা আমাকে
‘বাঙ্গালী’ বলে ডাকছে। দেখাদেখি সাধুবাবাও
আমাকে ‘বাঙ্গালী’ বলে ডাকতে শুরু করেছে। আমাকে ডেকে মাঝে মাঝেই ফাই ফরমাশ করছে, “এ বাঙ্গালী, যাও এক বালটি পানি লে আও।” আমার নিজের
নামটা হারিয়ে একটা কষ্ট আর অপমান বোধ হলেও কিছু করার মতন অবস্থায় নেই আমি।
সন্ধ্যাবেলায়
সাধুর সামনে কিছু লোক সমাগম হয়। সেদিন দেখলাম একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে তার মা
এসেছে। বাচ্চাটি অসুস্থ, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সাধুবাবা কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে
বললেন একে বন্ধন দিতে হবে। এই বলে বাচ্চাটির মাকে ডেকে নিয়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ
করে দিলেন। শুক্লাজী চোখ টিপে আমাকে বলল, “বন্ধন কা মানে সমঝতে হো?”
আমার বয়স আঠেরো, একুশ
বছর হলে প্রাপ্তবয়স্ক হব। শুক্লাজীর মুখ দেখে বুঝলাম বিষয়টি কঠোরভাবে
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। আমি মাথা নীচু করে রইলাম। শুক্লাজী কিন্তু আমাকে ছাড়লনা।
আমার গা টিপে বলল,”কুছ কুছ তো সমঝতে হো। কভি লেড়কিকে সাথ কুছ কিয়া?”
আমি উত্তর দিলামনা। চুপ করে বসে রইলাম।
সাধুবাবা আধঘন্টা
পরে ঘর খুলে বের হয়ে এলো। তার মিনিট কয়েক পরে মা’টিও বের হল। দুজনেরই মুখ দেখে মনে
হল যেন কিছুই হয়নি। সাধুবাবা কি একটা গুঁড়ো বাচ্চাটার কপালে মাখিয়ে দিল। বাচ্চা
কোলে করে মা বেরিয়ে চলে গেল।
লোকজন সব চলে
গেলে শুক্লাজী সাধুবাবার সামনে বসে রইল। আমিও বসে রইলাম। যদিও আমার বসে থাকতে
ইচ্ছা করছিলোনা। কিন্তু উঠলে হয়তো গালাগাল খেতে হবে এই ভয়ে বসে রইলাম। শুক্লাজী
বলল, “গুরুজী, বাঙ্গালীকে লিয়ে ভি কুছ বন্দোবস্ত কিজিয়ে। লেড়কা জওয়ান হ্যায়”।
এখানে নদীর ধারে
শ্রাবণ মাসে মেলা বসে। বেশ বড় মেলা। পরদিন বিকালে শুক্লাজী, সাধুবাবা, আমি আর দু
একজন লোক চললাম মেলা দেখতে। গ্রামের মেলা যেরকম হয়। নানা জিনিসের দোকান, নাগরদোলা
আর একটা অস্থায়ী যৌনপল্লী। মেলায় যে এরকম পল্লী থাকতে পারে আমার জানা ছিলনা। আমরা
অবশ্য সেদিকে গেলামনা। আমরা গেলাম নৌটঙ্কির নাচ দেখতে। নৌটঙ্কির কথা বইয়ে পড়েছি।
আমার ধারণা ছিল এটা ঝুমুর দলের মতই কোনো ব্যাপার হবে। পলাতক সিনেমায় ঝুমুরদলের নাচ
দেখেছি। দেখে মুগ্ধ হয়েছি। নতুন কিছু দেখার আশায় টিকিট কেটে তাঁবুর ভিতরে ঢুকলাম। মেঝেতে
চট পেতে বসার ব্যবস্থা। সাধুবাবার জন্য একটা চেয়ার পেতে দেওয়া হল। এখানে দেখলাম
একদল রঙ্গিন পোষাক পরা মেয়ে হিন্দী সিনেমার গানের সাথে নেচে চলেছে। নাচের মধ্যে
শরীর দেখানোর চেষ্টাই বেশি। গ্রামের অল্পবয়সী ছোকরারা মাঝে মাঝে সিটি দিচ্ছে আর দু
চার পয়সা স্টেজের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। সারা
সন্ধ্যা মুখে একটা বিস্বাদ আর মনের ভিতরে বিষাদ ভরে রইল।
নাচ দেখে বেরিয়ে
শুক্লাজী বলল, তুমি ধর্মশালায় ফিরে যাও, আমরা পরে আসছি। আমি ওদের রেখে ধর্মশালার
দিকে হেঁটে চললাম। অনেকটা পথ। আমার মনে হল ওরা রিক্সা করে ফিরবে বলে আমাকে আগে
পাঠিয়ে দিল। ধর্মশালার কাছে এক জায়গায় তিরিশ পয়সায় চারটে রুটি আর সবজি পাওয়া যায়।
তাই খেয়ে ধর্মশালায় ফিরে দেখি সাধুবাবা
নিজের আসনে বসে আর শুক্লাজী তার পাশে বসে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে কিসব কথা বলছে। আমাকে
দেখে ইশারায় বলল ঘরে যেতে।
ধর্মশালার
ঘরগুলির বেশিরভাগ দরজাই খারাপ, ভালো করে বন্ধ হয়না। তার উপরে অসংখ্য ছিদ্র। আমার
তাতে অসুবিধা নেই। আমি দরজা বন্ধ করে মোমবাতি জ্বালালাম। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি আমার
বিছানার উপর কে যেন শুয়ে আছে। একটি মেয়ে। আমাকে দেখে ধরমর করে উঠে বসল। বলল, “নিদ
লাগ গেলৈ।”
ডান দিকে আঁচল
দিয়ে শাড়ি পরা বছর পনেরোর একটি দেহাতী মেয়ে। চোখে মোটা করে কাজল পরা। কপালে একটা
টিপ আর গলায় কালো কার দিয়ে বাঁধা একটা মাদুলী।
আমি তো অবাক।
বললাম, “তুমি কে? এখানে কী করছ?”
মেয়েটি আমার দিকে
তাকিয়ে বলল,”সাধুবাবা ভেজ দেলৈ, তোহরকা সাথ সোনে কে লিয়ে”। আমি এরকম একটা কথা
শোনার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলামনা। মেয়েটাও কি অবলীলায় কথাটা বলে ফেলল।
আমি ব্যাপারটা
বুঝতে পারলাম। কদিন ধরে সাধুবাবা আর শুক্লা এই মতলব করছিল আমাকে যৌবনের স্বাদ
পাওয়ানোর জন্য। হয়তো মেলার যৌনপল্লী থেকে একে নিয়ে এসেছে। কী উদ্দেশ্যে কে জানে।
আমি মেয়েটার
মুখের দিকে তাকালাম। সুন্দর বলা যাবেনা, কিন্তু একটা শ্যামল লাবন্যের ছোঁয়া রয়েছে
মুখে। চোখের ওই কাজল ছাড়া আর কোনো প্রসাধন নেই। আমার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলল,
“আও ইধর।”
আমার খুব লোভ হল।
যুবক হওয়ার পর থেকেই একটা মেয়েকে শারীরিক ভাবে পাশে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। এই
আনন্দ যে কীকরে উপভোগ করতে হয় তার কিছু জ্ঞানও লাভ হয়েছে বন্ধুদের থেকে। কিন্তু তা
এভাবে আমার মুখের সামনে চলে আসবে ভাবিনি।
পরক্ষণেই একটা ভয়
হল। কোন পল্লীর থেকে এই মেয়েটা এসেছে কে জানে। শরীরে অসুখ বিসুখ নেই তো। ভাবতে
ভাবতেই এক প্রবল নীতিবোধ জেগে উঠল। একটা যৌনপল্লীর মেয়েকে এভাবে উপভোগ করা
একেবারেই ঠিক নয়। এসব আমাকে মানায়না।
কিছুক্ষণ ধরে লোভ, নীতি আর ভয়ের মধ্যে সংঘাত চলল। কতক্ষন তা চলত জানিনা।
হয়তো আমার নীতিবোধই পরাজিত হত। ভয়টা অমূলক বলে হয়তো উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু দরজার
ওপারে একটা শব্দ শুনে আমি সচেতন হয়ে গেলাম। গিয়ে দরজা খুলে দেখি সাধুবাবা আর
শুক্লাজী দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। দরজার অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে দুজনে আমাকে দেখছিল এতক্ষণ।
আমি এবারে ওদের মতলব বুঝতে পারলাম। আমাকে মাধ্যম
করে এক ধরণের দর্শনসুখ পাওয়ার আশায় এরা মেয়েটিকে নিয়ে এসেছে। এরা
অত্যন্ত নীচ বিকৃতরুচির মানুষ। আমি আমার কর্তব্য স্থির করে ফেললাম। এদের কাছে আমি
হেরে যাবনা। আমি মেয়েটার হাত ধরে টেনে এনে সাধুবাবার দিকে ঠেলে দিলাম। তারপর ঘরের
দরজা বন্ধ করে চৌকির উপর এসে বসলাম।
আমার মনে পড়তে
থাকল আমি জলপাইগুড়ি জেলাস্কুলের প্রথম সারির ছাত্র ছিলাম। আমার স্কুলের থেকে দূরে
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়া যায়। পাশেই বিস্তীর্ণ তিস্তানদী। আমি কবিতা লিখতে পারি। আবৃত্তিতে আমার রীতিমত
নাম আছে। আমার মা একটা স্কুলের হেড মিস্ট্রেস। পাড়ার লোকেরা আমাদেরকে বিশেষ সমীহ
করে। সেই আমি কোন এক ক্লেদাক্ত আবর্তের মধ্যে এসে পড়েছি। চৌকির উপর
স্থির হয়ে বসে এই কথাই ভাবতে থাকলাম।
সময় বয়ে যেতে
থাকল।
No comments:
Post a Comment