কাঁসার বাটিতে
গরম দুধের সে গন্ধ আবার কেন ঘুরে এল!সেত কতদিন আগের কথা।মাটির বারান্দায় জলচৌকিতে
বসে আছেন ঠাকুমা।মা অফিস ফেরত গা ধুয়ে ধোয়া শাড়ীটা টেনে জড়িয়ে নিয়েছেন,সন্ধে হয় হয় ।বিষন্ন আকাশ মেঘান্ধকার।থম মেরে আছে শুধু।তাড়াতাড়ি তুলসী
তলে শাঁখে ফুঁ দেন মা।লালচে রঙা তুলসী বেদীটা বাড়ীর মাঝ উঠোনে,গাল ফুলিয়ে শাঁখে ফুঁ দিতে দিতেই চোখের ইশারায় জানান দেওয়া...পড়তে বসো
গে যাও...।
ইচ্ছে একটুও নেই।ততক্ষণে কালো রাজ আমলের কাঠের কারুকার্য
করা ক্যাম্বিসের খাটের উপর ঠাকুমার পাশে অষ্টোত্তর শতনাম আওড়ে যাওয়ার সুখ কত বুঝে
গেছি,আর দূরে কোঁক প্যাঁচা
ডাকলেই...একশো...নিরানব্বুই...আটানব্বুই...গুনতে গুনতে একে পৌঁছে যাওয়া।কি
আশ্চর্য!পেঁচাটাও চুপ।সে বিশ্বাস কেমন বুকের মধ্যে স্ফটিক স্ফটিক।আর ঠিক তারপর ই
লাল শালু মোড়ানো শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য চরিতামৃত বের করবেন হেমনলিনী দেবী..
আমার ঠাকুরমাতা
ঠাকুরানী।ছেঁড়া ছেঁড়া সে পৃষ্ঠার ওপাশ ওপাশে আঁকা ঠাকুর দেবতার মানুষ মানুষ ছবি কি
অপূর্ব! এখন ও মনে করতে পারি লেখকের জায়গায় সে হলদে হয়ে যাওয়া পৃষ্ঠায় নাম ছিল 'কৃষ্ণদাস কবিরাজ'।আর অন্য ভাই বোনেরা সন্ধে
লাগতেই বাড়ীর উঠোনের ধারে ধারে কেউ আনাজ কুটতে বসে
গেল, কেউ গরম গরম চা গেলাসে নিয়ে মুখে সুলুক শব্দ তুলে
পরিতৃপ্তির চুমুক দিতে শুরু করেছে,কোন জেঠিমা সাজানো তোলা
উনুনে উঠোনের কোণে ফোকর দিয়ে আগুন সেধিঁয়েছে,ধোঁয়া উঠছে
গলগলিয়ে গুল দেওয়া উনুনের চূড়োর মত মাথার উপর দিয়ে,ভেসে
যাচ্ছে আকাশের দিকে।তখন থেকেইতো জানতে শুরু এই ধোঁয়ারাই মেঘ তৈরি করবে।যেমন
ট্রেনের ঝমঝমের সঙ্গে যত কালো ধোঁয়া সব আকাশে উড়ছে তো উড়ছেই। শুধু আমি এসব দেখতে
দেখতেই কখন যেন প্রতি সন্ধেতে ঠাকুমার কাছ ঘেঁষাঘেঁষি।মার বেজায় চটে যাওয়া গরম
দুটো চোখের দিকে ইচ্ছে করেই তাকাইনি কখনো।যতদিন ঠাকুমা আগলে ছিলেন আর পুরাণ কথা
শোনাতেন।মার মুখ দেখে মনে হত আমি বুঝি সন্ধের পড়াশুনো বাদ দিয়ে গোল্লায় যাচ্ছি।
ঠাকুমা কি বুঝতেন না? বেশ বুঝতেন,বাবা ফিরলে মাঝে মাঝে বলতেন,মেয়েডারে সন্ধায়
পড়ানোর কি দরকার, আমিই কত কাহিনী বলি...সব মনে থাকবে
দেখিস তোরা। সে কথা সে ছবি,ঠাকুমার কালো জলচৌকিতে বসে খবর
কাগজ পড়ার ছবি কখনো ভুলিনা।গোল গোল চশমায় সে বিদুষীকে দেখে তখন ও ভেবেছি এখন ও
ভাবি...ফিটন গাড়ী চড়ে প্রথম মেম সাহেবের কাছে পড়তে যাওয়া সুনীতি কালেজে যাওয়া
বাড়ীর বধূটি...তোমার ফরসা গোলপানা মুখ সে উজ্জ্বল আলো কেউ দেখলনা!কেউ জানলনা তোমার
কথা।আমিও দেখ কেমন,স্কুল ফেরত ছিটকে দেওয়া ব ইয়ের বাক্স,জলের বোতল,জুতো মোজা ছুঁড়ে ফেলে তোমাকে কত
বিরক্ত করেছি। খোলা উঠোনের বাড়ীটায় রোদ বৃষ্টির অহরহ খেলায় কোথাও জড়ানো পুঁইলতা,কোথাও লাউ কুমড়োর ঝুলতে থাকা ডগা,একটু দূরে
কুয়োতলায় জোড়া নারকেল গাছ মাথা দোলালেই মনে হত,তুমি আর
দাদু দাঁড়িয়ে আছ।...আর কালবৈশাখী ঝড়ে গাছগুলো যখন এতোল বেতোল ঝাপটা দিত,ঝরত বৃষ্টি অঝোর,তুমি,মা,জেঠিমা যার যার ঘরের চালের ঝরঝরানি জলের
নীচে সিঁড়ির উপর পেতে দিতে বালতি।একের পর এক লোহার বালতি পাতা থাকত।রূপোর মত জলে
ভরে যেত।কতদিন উঠোন পেরিয়ে কুয়োতলায় বৃষ্টি পেরিয়ে শেওলায় পিছলে যাওয়ার ভয়ে না
নিয়ে গিয়ে ঐ সিঁড়িতে বসেই আমার স্নান হয়ে যেত।সে জলের স্বচ্ছতা,পরিশ্রুত ধারা আজ ও পবিত্র করে আমাকে।ভাবলে দু চোখ বুজে আসে আরামে।মার
শক্ত হাতের মার চপেটাঘাত কতবার যে জুটেছৈ,অনেক সময়
বিনাকারণেও...এখনো তার কারণ তলিয়ে ভাবতে গিয়ে বুঝি কাজের চাপ,ঘরে বাইরে মার মেজাজকে চড়িয়ে দিত।কিন্তু মুখে কথা বলা ঝগড়া করা
স্বভাবেই ছিলনা তাঁর আবার যৌথ বাড়ীর বৌ ঝিয়েদের মত গুজব,সমালোচনা
কিংবা এর ওর ঘরের কথায় যোগ দেওয়া একেবারেই স্বভাবে ছিলনা।ফলে অন্যান্যদের
চক্ষুশূল হয়ে উঠতেন সহজেই।তার উপর অসম্ভব সুন্দরী হ ওয়াও আর সকলের চোখে খুব
ভালবাসা পেতনা।মাকে এসবের মধ্যেই সমস্ত গুছিয়ে সেরে রেখে অফিস
যেতে হত,ফিরে এসে কোন কোন দিন রাঁধতেও
দেখেছি।ঠাকুমার সঙ্গে বাড়ীর ছোটবৌ আমার মায়ের সখ্য ও ছিল চোখে পড়ার মত।জীবনের
শেষদিন পর্যন্ত মায়ের সেবাতেই ছিলেন ঠাকুমা।মাঝে মাঝেই যৌথ ঘরানায় অনেক নীচ
প্রবৃত্তি চোখে পড়ত,দেখেছি শুনেছি কিন্তু কোনটা নিতে হয়,কোনটা নিতে হয়না,শুনতে নেই এও বুঝি মা ঠাকুমার
সান্নিধ্য শিখিয়ে দিয়েছিল।
ধবধবে সাদা থানে ঠাকুমাটি খুব বেশী
বয়স পর্যন্ত বাঁচেননি। হঠাৎ একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন ঘরের মাঝখানে।মাথার পিছন দিকে
ফেটে রক্ত গড়ালো।বাড়ীর ডাক্তার চিত্তকাকু কল দিলেই চলে আসতেন।আমাদের জ্বর জারিতেও
লাল মিক্সচার আর সাদা ট্যাবলেট অর্ধেক খেয়ে নিলেই কমে যেত সব।এখন আর এমন ডাক্তার
পাইনা।বাড়ীতেও বেশীরভাগ আসেননা।মুমূর্ষু রোগীকেও ডাক্তারের চেম্বারে ধর্না দিতে
হয়।...সেই চিত্তরঞ্জন ব্যানার্জি,ডাক্তার মানুষটি
ঠাকুরমার চিকিৎসা করলেন। মাথার চুল ছেঁটে দেওয়া হল বলে বড় দু:খ পেলেন।কিন্তু মাথার
আঘাতে ড্রেস করতে,ব্যান্ডেজ বাঁধতে ওটা দরকার ছিল।আমার
তখন ক্লাস সেভেন।কেমন ঘুলিয়ে গেল সব।ঠাকুমা
শুধু শুয়ে আছেন,এটা ভাবতে দেখতে ভাল
লাগতনা।কষ্ট হত,কেমন ভয় হতো।দূর থেকে দরজা
ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম।ভাবিনি কখনো ঠাকুমাকে চলে যেতে
হবে।সুস্থ হয়ে আবার ঘরের মধ্যেই টুক টুক হাঁটছিলেন,কিন্তু ভুলে যেতে শুরু করলেন সব কিছু।রাতে সাড়ে সাত,আটটার মধ্যে ঠাকুমাকে খ ই দুধ বা রুটি দুধ খাওয়ানো হত।মা ই দিতেন
খাইয়ে।পরক্ষণেই ঘন্টা দুয়েক হতে না হতেই উঠে ঘরময় হাঁটতেন আর বাবার নাম ধরে ডেকে
বলতেন,নিতু,আজ আমাকে খেতে
দেয়নি।রাতে তো খাইনি আমি! এমন ধীরে ধীরে সব ভুলে যেতে আরম্ভ করলেন।লাল শালু মোড়া ব
ই গুলো ওমনি তোলা র ইল তাকে।ঠাকুমা চলে যেতে সেসব বাবার আলমারিতে যত্নে থাকল।খুব
কষ্ট হত ,বুকের ভেতর কেমন সব হারানোর শূন্যতা বেজে
উঠত।সে বোধ এখন ও আছে,এ মাঝ বয়সেও।
শৈশবের মৃত্যুর কাছাকাছি ততদিনে ঘুরে এসেছি আমি।আমার
প্রিয় ফুল জেঠুর মৃত্যুর আবছায়া ছবিতে।তুলসী মঞ্চের সামনে উঠোনে শোয়ানো প্রিয়
মানুষ...এটুকুই আড়াই বছর বয়সী আমার দুচোখ দেখেছিল।ব্যস সে ছায়াটুকুই এখন ও আমায়
তাড়িয়ে বেড়ায়।কবিতায়,গদ্যে সে ছায়া ছায়া শব্দ অনেকবার রূপ
নিয়েছে।কিন্তু ঠাকুমার মৃত্যুকে দেখেছি প্রথম প্রিয়জন হারানোর দিনগুলো রাতগুলোকে
ছুঁয়ে ছেনে।বাবা জেঠুরা সকলে গুরুদশা পালন করছেন,কাকদের
ডেকে খাওয়াচ্ছেন।এক ই কোরা মার্কিন কাপড়ের ধুতি স্নানের পর নদী পাড়েই শুকিয়ে
নিচ্ছেন,আমি অপেক্ষা করে আছি অন্য দাদা দিদিরের সঙ্গে নদীর
কাছাকাছি আমার তোর্সা নদীর স্রোতের কাছে।
সেই সময় সন্ধেটা আর ও যেন সব একাকার হয়ে যাওয়ার
পালা।ঠাকুমার শরীর যেখানে শোয়ানো ছিল বাড়ীর উঠোনের সে জায়গাটুকু সুতো আর কাঠিতে
চিহ্নিত করা ছিল,সেখানেই প্রদীপ জ্বেলে প্রতি সন্ধেয়
বাড়ীর সবাই একসাথে হয়েছি,আমাদের বৈষ্ণব বাড়ীর ছেলেদের
কন্ঠের সুমধুর কীর্তন আকাশ বাতাস মুখরিত করত,আমিও গেয়েছি
খোলা গলায়'জয় রাধে,রাধে,রাধে কৃষ্ণ গোবিন্দ বোল...'
কখন যেন বাড়ীর মানুষের সংখ্যা কমতে আরম্ভ করল আর আমি বড়
হলাম।বিরাট যৌথ বাড়ীর বড় রান্নাঘরে ভাগাভাগি হল।দেখলাম মা ঘেমে নেয়ে অফিস থেকে
ফিরে নতুন হাঁড়িতে অন্য নতুন অপরিচিত উনুনে আমাদের রান্না চাপিয়েছেন,আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি।সেইতো বিস্ময়ের শুরু,আসল নকল,ভাল মন্দ,আপন
পর বোধ তৈরি হচ্ছে সবে।তবে সেসব এখন ও ঠিকঠাক বুঝিনা,তখন
ও বুঝিনি আমি।একটু হাসিকেও মনে হয় আত্মনিবেদন বড় ভালোবাসার,বড় মুখরতার।
এখন কেমন মনে হয় এইযে যৌথ বাড়ীর কঠিন কোমল,অম্ল মধুর,ভাল মন্দ,সুনীতি
কু নীতি এত সব আমার ছেলে মেয়ের মধ্যে বিস্তৃত করে দিতে পারিনি ইচ্ছে
থাকলেও।কিন্তু সেটা দরকার।মানবিক গুণ,মনুষ্যত্ববোধোর
স্ফুরণ হতে গেলে হয়তো এমন একঘর গুরুজনদের দরকার হয়,যাঁরা
সারাজীবন আলো দেখিয়ে চলেন আমাদের অন্ধকার ও স্পষ্ট হয়।বড় একপেশে...একার জীবন
এখন।কখনো অনুভব করিনা তাও যে একা আছি।কখনো মনে হয় মা ডাকছেন,কখনো দেখি বাবা অফিস থেকে ফিরেই আমার স্কুলের সুটকেশ খুলে একে একে খাতা
বের করছেন,সব লিখেছি কিনা...কখনো বা বাবার সঙ্গে গলা
মিলিয়ে বলে উঠছি...গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা,কূলে একা বসে
আছি নাহি ভরসা...,কখনো মা এসে আমার ঘুমিয়ে পড়া শরীরে টেনে
দিচ্ছেন পাতলা চাদরখানা,আমি শান্তিতে দু চোখ বুজছি।এইতো
গভীর বোধ,পরদিন সকালের সূর্যটা আবার নতুন করে ছুটতে বলে
আমার শরীর ধরে ঝাঁকিয়ে দেয়,ভিতর পানে বাসা বাঁধে সেই চার
উঠোনের গল্প।ঘুমিয়ে পড়া নগরী নয়,চারদিকে মানুষ মানুষ
ভীড়।তাদের ছুঁয়ে থাকা,ভালোবাসা আর সুরে সুরে বাস করা,সে সুর মানবতার আর মিলনের।
No comments:
Post a Comment