Sunday, July 21, 2019

দীপ জ্বালে ওই তারা...--মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া



         




এক মুঠো মৌরিলজেন্স হাতে দৌড়চ্ছিল সে। দে বলছি ঝিনি,না, তুই কেন আমার মাছটফির সবটা খেলি? দাঁড়া,দ্যাখ তোর কি করি,বলতে বলতে ছোড়দা তার ঘাড়ে এসে পড়ে আর মুঠো থেকে ছড়িয়ে যায় খুদি খুদি মৌরি লজেন্স। খুব জোরে খিমচে দেয় সে। খিমচোনো জায়গাটাতে খানিক হাত বুলিয়ে ছোড়দা বলে,তুই,ঝিনি আমাদের বাড়ির মেয়েই নোস। তার মানে কি?এমনিতেই লজেন্সের শোকে তার চোখে জল গড়াচ্ছিল। আরে গাধা,রোজ সকালে করিমভাই যখন বাগানের কাজ করে,রুবিদি চা-রুটি  আর বিড়ি দেয় না ছটা করে,বিড়ির বান্ডিলে লেখা থাকে মন্টু বিড়ি ফ্যাক্টরি;তুই ওই মন্টু বিড়িদের মেয়ে। আমরা তোকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। মোটেও কক্ষনো আমি মন্টু বিড়িদের মেয়ে হব না, বাজেদের মত কথা বলবি না, ঝিনির হাত-পা চলতে থাকে, ছোড়দাও কিছু থেমে থাকে না ফলে খানিক বাদেই কাঁদতে কাঁদতে মার কাছে দৌড়োয় সে। মা, আমি ঝিনি না? হ্যা, তুমিতো ঝিনিই। তুমি কোথায় পেয়েছিলে আমাকে? আমি কোথায় থেকে এলাম? খাতা দেখা থেকে মুখ তুলে জলভরা ব্যাকুল তার মুখের দিকে তাকিয়ে মা বললো,সেতো এক গল্প। সন্ধেবেলা গা ধুয়ে বাগানে বেড়াচ্ছিলামতো, চাঁদও উঠেছিল বাঁকা একখানা। আর ছোট্ট ছোট্ট তারা? হ্যা, ওই তারাইতো দেখছিলাম। আর ভাবছিলাম ছোট্ট ওই তারার মত মিষ্টি একটা মেয়ে যদি থাকত গো! স্নোহোয়াইটের রাণীর মত ভাবলে? এক্কেবারে ওরকম।তা ভাবতে ভাবতেই দেখি টুপ করে একটা তারা খসে পড়ল ওই কুন্দ ফুলের ঝোঁপটাতে। দৌড়ে গিয়ে দেখি,ওমা! তারা কোথায়, এতো ছোট্ট একটা মেয়ে।সাত ভাই চম্পার মত? মাটিতে পড়েই রাজপুত্তুর হয়ে যাওয়ার মত? অবিকল সেরকম। কি করলে তখন? অতটুকু বেবীতো, দোলা দিতেই ঘুমিয়ে গেল। সেইতো আমার ঝিনুকমা। এখন পড়তে বোসোগে,চা করতে হবে আমায়।  
            মার কাছ থেকে লাফাতে লাফাতে দাদাদের কাছে গিয়ে বলে মন্টু বিড়ি বলবি না,মা বলেছে ফুলের বনে কুড়িয়ে পেয়েছে আমায়। ওই দ্যাখ,কুড়িয়ে পেয়েছে বলেছে না।বিড়িরা ফেলে গেছিল,আমরা পেয়ে গেলাম। সত্যি?সত্যি নাতোকি? ধাঁধায় পড়ে যায় সে আর চোপসানো তার মুখের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ছোড়দা বলে বাদ দে ,স্পোর্টস এসে গেছে তা জানিস? কে এসেছে? হাঁদাই কটকটি একটা স্পোর্টস মানে খেলা। স্কুলে খেলা হবে।তোদের প্রাইমারি সেকশানেওতো হবে। নাম দিসনি? দাঁড়া, কাল টিফিনের সময় তোদের ক্লাসটিচারের কাছে গিয়ে দিয়ে আসবখন,কিছুইতো পারিস না ,হাঁদারাম একটা। আমি খুব দৌড়োই জানিস ছোড়দা। আচ্ছা,দেখা যাবে,বোনের মাথায় হাল্কা চাঁটা লাগায় সে।
            দৌড়ে অবশ্য মোটেও সে পারে না,তার পাশ দিয়ে শনশন ফনফন করে সব্বাই বেরিয়ে যায়। স্কিপিংএ চারজনের পরেই সে আউট,মনোযোগ পরীক্ষাতেও সে হুশহুশ করে গাছ-বাড়ি-পাখি সবই উড়িয়ে দেয়। অ্যাই ঝিনি,ঠিক করে খেলবি,এরপর টমেটো দৌড় তোদের,এটাই তোর লাস্ট চান্স,দাদামনি এসে বলে যায়,খুবতো দৌড়লি ছোড়দা খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসে। মাঠের অন্যদিকে দাদাদের খেলা। দৌড় আর লংজাম্পে জিতে গেছে ওরা হাইজাম্পেও নাম ডাকছে বলে দৌড়ে গেল ওদিকে। বুকে লাল ফিতে আঁটা বড় দাদারা হাত বেঁধে তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল। কিন্তু টমেটোগুলো এতই নাচানাচি করে যে সে কামড়াতেই পারে না;বুবাই-ঝুমারা সব পৌঁছে যায় উঁচু এক ভিকট্রি স্ট্যান্ডে।
             এর-তার  ফাঁক গলে সে বেরিয়ে আসে ভিড় থেকে। একাএকা হাঁটে। মস্ত মাঠের এক্কেবারে শেষে ছোট ছোট হলুদ ফুলে ভরা এক বাবলা গাছের তলায় এসে দাঁড়ালো। কি একটা হচ্ছে যেন তার,কি তা সে বুঝতে পারে না, সেকি কিছু হারিয়ে ফেলছে? দাদারা পেরেছে, সে কিছু পারেনি, না পারলে সে ঝিনি কি করে হবে, সত্যি কি সে  কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে নাকি? তাই সে কিচ্ছু পারে না? বাবলা গাছের আড়ালে ফুঁপিয়ে ওঠে সে। খেলনা ভাঙা,টিচারের ধমক,মার বকুনি বা স্কেলপেটা, দাদাদের যম খ্যাপানো বা রামঠেঙানি নয়,বাবলাতলার আবছা অন্ধকারে দাদারা যখন তাকে খুঁজে পেল, এসবের বাইরে হেরে যাওয়ার প্রথম দুঃখে সে তখন লুকিয়ে কাঁদছিল।
              অবিশ্যি বাড়ি ফিরে সে নতুন উত্তেজনায় ভুলে গেল বেমালুম কেন না সেজমাসি, যাকে সে হেম বলেই ডাকে,এসে গেছে  ছোট্ট সানাকে নিয়ে। কদিন ধরেই মা-বাপি পাসপোর্ট- ভিসা  নিয়ে ছুটোছুটি করছে খুব, কলেজে ছুটিও পড়ে গেছে বাপির,সবাই মিলে তারা যাবে বাংলাদেশে মামার বাড়ি। যাওয়ার আগের দিন,বনগাঁয় বড়মাসির বাড়ি গিয়ে থাকল। মা-মাসির গল্পতো ফুরোতেই চায় না,বড়মাসিই তাড়া লাগালো সবাইকে,নে অইসে,বইয়া বইয়া প্যাঁচাল পোটলেই অইব ? কাইল যাওনের ধগল নাই তগো?খাইয়া ল অহন। রাতেতো উত্তেজনায় ঘুমই আসতে চায় না।
               দুদেশের চেকপোষ্ট পেরিয়ে,বাস পাল্টে খুলনার স্টিমারে উঠতে বেলা গড়ালো। রেলিং ধরে ডেকে দাঁড়ালো সে,জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছে স্টিমার আর সূর্যের থালাটা জলের মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বিকেলের কিনার ঘেঁসে। নাম কি নদীটার? নদী নয়রে,এ হল ভৈরব নদ। এখন চলো, সবাই মিলে খেয়ে নিই। কলাপাতায়, গরম ভাত,আলুভাজা, ডাল আর ইলিশমাছ খিদে পেটে কি যে ভাল লাগলো। ঝিনি, শুতে চল। হেম, সানাকে নিয়ে কেবিনে ঢুকল। দাদাদের নিয়ে বাপি, চাদর বিছিয়ে ডেকেই বসেছে। এখানেই শুই না মা? দেখছো না কত অচেনা মানুষ শুয়ে আছে,বড় হচ্ছ, বোঝার চেষ্টা করো ঝিনি, মা চাপা গলায় ধমক দেয়। তালে আর একটু থাকি ? মা চলে যেতেই ছোড়দার পাশে টানটান হয় সে। খোলা আকাশে অগুনতি তারা, কাঁপছে, দুলছে, মিটমিট করছে। বাপি চেনাচ্ছে,ওই ধ্রুবতারা দেখে জাহাজের দিক ঠিক করত নাবিকরা। জিজ্ঞাসা চিনহের মত ওই সপ্তর্ষি, লালচে মঙ্গল গ্রহ ওটা,অই দ্যাখো জুপিটার, কালপুরুষের পাশেই বসে আছে,শিকারি কুকুর লুদ্ধক। খোলা হাওয়ায়, এঞ্জিনের আওয়াজে বাপির কথা ভেসে যাচ্ছে। ছায়াপথ ধরে আরও কতদূর সে যাচ্ছে, আচ্ছা,সবারই কি এমন হয়? এই যে দুরের মত কি এক অচেনা তার ভেতর ঢুকে পড়ছে,ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে তার চারপাশ,পরক্ষনেই ভরে উঠছে আবার, 'রম লাগে সবার? একেই কি বড় হওয়া বলে?
               স্টিমার থেকে নেমে ভোরভোর ছইদেওয়া এক নৌকো চড়েছিল তারা। গনগনে সূর্য যখন মাথার ওপরে,সে নৌকো গেল চড়ায় ঠেকে। মা মাসির মুখ শুকিয়ে গেল। সানাকে দেখিয়ে বাপি বড় মাঝিকে বললো কিছু করুন দাদা,দুধের শিশু পর্যন্ত সঙ্গে, বোঝলামতো হগগলডি,করুম কি? জোয়ারের লাইগ্যা বইয়াই থাওন লাগব অহন। হইছেডা কি? ও মাজিবাই? নদীতে স্নান করছিল কিছু লোক, ছেলেপুলেরা ঝাঁপাই জুড়েছিল,কাপড় কাচা থামিয়ে বউঝিরা অবাক হয়ে দেখছিল। যাইবেন কই? নরের কাডি,রায়বাড়ি। অরে অই আলি,কুদ্দুস,বোলা দেহি হগগলরে,ঠ্যালতে অইব নাওডারে। মাজিবাই, গুন লইয়া ছ্যামরাডারে লামাইয়া দ্যান,অয় টান দিক। আট-দশজন মিলে চড়া পার করে দিল তারা। বড্ড উপকার করলেন ভাই, কন কি? মোগো দ্যাশের জামাই আফনে। দুফ্যারে পোলাপান লইয়া দুগগা ডাইলবাত,বাপি হাতজোড় করে বলে, আবার আসব।
         বুঝলেন অনির্বাণবাবু,দাদামনিকে ডেকে বাপি বলল,এই আমাদের দেশ, দানি বলে,সেরা দেশ,সোনার দেশ,ফলন্ত,ফুটন্ত বাংলাদেশ। বুড়ো আংলা থেকে ঝাড়ছে, ছোড়দা ফুট কাটলো। ঠিক জায়গায় ঠিকঠাক ঝাড়াঝাড়ি খুবই ভাল,কল্লোলবাবু,আরও ভাল,সেটা আপনি বুঝেছেন তবে মানুষ ছাড়াতো দেশ হয় না বাবা,সোনার দেশই বটে,অন্যকে আপন করে নেবার মত,অন্যের বিপদে বুক দিয়ে আগলাবার মত মন আছে যাদের, সেইসব সোনার মানুষ নিয়ে এই দেশ,শুধু তাদের খেপিয়ে তোলে দুষ্টু কিছু লোক।ছইয়ে হেলান দিয়ে বসে নদীর ধারের গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকে ঝিনি।ওপারে ছায়াঢাকা একটুখানি মাটির পথ দেখা যায়। কি আছে ওই পথে? মাটির দাওয়ায় দুটো বাচ্চা খেলছে। আনি-ই বলে কেউ ডাকল। রোদলেগে খোড়ো চাল ঝকমক করছে। বাপির কথার সাথে মিলিয়ে সোনালি রঙ ধরা এই ছবিটাই টলটলে এক ফোঁটা মুক্তর মত ঝিনুকের বুকে গেঁথে গেল।
           খিদে-তেষ্টা-ক্লান্তিতে তারা যখন নেতিয়ে পড়েছে বিকেল গড়িয়ে তাদের নৌকো এসে ঠেকল মামাবাড়ির ঘাটে। বইতে দে অগো, জল খাইতে দে, ও আরতি,শীতল পাটিডা লাছা,তরাতরি মায়রে বোলা।কও দেহি, আইজই নয়াবাড়ি যাওন লাগল তার!অ তপইন্যা,তর মায় কি লতুন বউ হইয়া বইছেনি? বাইরায় না ক্যান? মামুর হাঁকডাকে সোনামামি বেরিয়ে আসে আর ঝালর দেয়া পাখায় বাতাস করতে করতে,ডাঙ্গর হইছেনি? ও বেলা,বীণার মাইয়াডা, সুন্দার হইছেনি? তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে মামি ।ঝিনির মনে পড়ে যায় মার মুখে শুনেছিল কি একটা অসুখে বহুদিন হল সোনামামি অন্ধ হয়ে গেছে।
          পেয়ারাবাগানগুলো সরু সরু খাল দিয়ে ঘেরা এমন,মনে হয় একটা দ্বীপ।তাকে বলে কান্দি।তপনদা,তুহিনদার সাথে ডিঙি চেপে ঘোরে তারা। অই অইল আমাগো গইয়া কান্দি।সব বাগানই এমনি জলে ঘেরা? , কান্দির গর এমুনিতো অইব। গইয়ার ফলন বালা অয়।অহনতো ফুল ধরছে, আষাঢ়-ছাবুন মাসে নাও বুজাই গইয়া এই খাল বাইয়া জালোকাডির আডে যাইব গা। কিছু ফল এখনো আছে গাছে। পাখি আর বাদুড় নীচে ফেলেছে পাকাফল।পেয়ারাকে তোমরা গইয়া বল? ,গাছের বগলে যাইয়া কও দেহি, বান্দুর বান্দুর সয়া/মোরে একখান গইয়া ।দেখবা টুপপুস কইরা একখান গইয়া তোমার লাইগ্যা ফালাইয়া দিব আনে। মানে কি? সয়া মানে বোজঝোনি,বন্দু।আরে বাদুড়কে যদি তুই বলিস,বন্ধু আমায় একটা পেয়ারা দাও,সে পেয়ারা ফেলবে তোর জন্য। দানি বলে আর সবাই মিলে হাসে তারা।
           থোপা থোপা ফল এনে তুহিনদা বলে খাইয়া দ্যাহো মিডা ব্যাতের ফল।দানি শুয়ে পড়ল ঘাসের ওপর। জলমাখা হাওয়ায় ঝিরঝিরে পেয়ারার ফুলের শাদা পাপড়ি ঘুরে ঘুরে নেমে আসছে।লালচে একটা বেতের ফল হাতে বসে থাকতে কেমন ভাল লাগে,মনে হয় রূপকথার মত সব চেয়ে সুন্দর দেশে পৌঁছে গেছে যেন।
            অ মনুরা,দেইখ্যা যাও,তোমাগো মামু কতফোর ইলিশডা আডের থিক্যা আনছে। দিদুনের কথায় তারা মাছ দেখতে ছোটে। নিপুণ হাতে আঁশ ছাড়িয়ে গাদাপেটি আলাদা করছে সোনামামি।হাসছে আর বলছে পিডা খাইবা?বানাইছি।চুষি পিডা খাইছ,অ মনু? গভীর কোন মায়া মেঘলা ছায়ার মত সোনা মামির মুখে খেলা করে।আর মায়ের দেয়া জিনিসগুলো নাড়তে চাড়তে আরতিদি বলে ইন্ডিয়ার সাজনের  জিনিসগুলান কি সুন্দার,এহানের হাউসের জিনিসেরতো ঢকপদ নাই।তোমার পছন্দ? খুবই বালা। নিজের হেয়ারব্যাণ্ডটা খুলে তাকে পরিয়ে দেয় ঝিনি।
         দুদিন ধরেই তপনদার সাথে ছোড়দার কি ফিসফাস চলছে। এক ভোরবেলা উধাও তারা। ল্যাহাপরার লামে খোঁজ নাই,আবার ভাইডারে লইয়া বাইরাইছে হারামজাদায় আউক দেহি ,পিডের উপর চ্যালাকাড ভাঙুম আইজ। হাতে এক টিয়াপাখি নিয়ে বেলা গড়িয়ে ফিরে এল তারা। তপনদাদের ইশকুলে ঘণ্টা বাজায় যে সে আঠাকাঠি না কি দিয়ে জানি পাখি ধরতে পারে। পিসবোর্ডের বাক্স ফুটো করে করে তাকে নিয়ে আসার ব্যাবস্থাও পাকা।
          সন্ধেবেলা বাপি মামুকে বলল,ওদেশে যাওয়ার কথা কিছু ভাবলেন দাদা? গইয়ার ফলন আগের চাইতে কমছে,ধাইনও। ইশকুলের চাকরিতেও লানান ব্যানিয়ম।তবে কি জানো ধীর‍্যান,মোর পোলাপান উচ্চশিক্ষার পর যদি যাইতে চায় মুই না করুম না তয় মুই নিজেএই বয়সে আর উদ্বাস্তু হইতে চাই না। উদ্বাস্তু মানে কি মা? ভিজে চোখে অদ্ভুতভাবে তাকালো মা।
           আমার পাখিইই, ভোরবেলা চিৎকার দিল ছোড়দা,নির্ঘাত বেড়ালের কাণ্ড!কক্ষনো না।বেড়াল দড়ি দিয়ে বাঁধা বাক্সের গিঁট খুলতেই পারে না,আমি জানি কোন বেড়ালের কাণ্ড,বলতে বলতে বাঘের মত লাফ দিল ছোড়দা তার ঘাড়ে। বাপি এসে ছাড়ানোর আগেই পিঠে ধাঁইধাঁই গোটাকতক পড়ে গেছে। কত কষ্ট করে সারাদিন দৌড়ে, কত উচু গাছে চড়ে বগাকাকাকে দিয়ে ধরলাম পাখিটা!পারবি তুই ঢ্যাঁড়শ কোথাকারে।স্পোর্টসের দিন কিচ্ছু না পেরে পারিসতো বাবলা তলায় ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে।মন্টু বিড়িকে আজ মেরেই ফেলব, ছোড়দা তখনও রেগে ফোঁসফোঁস করছিল। এমন কেন করলে ঝিনুক? কত কষ্ট করে ছোড়দা বেচারা জোগাড় করেছিল পাখিটা?
তুমিতো বলেছো এটা সোনার দেশ।ওকে নিয়ে গেলে ওতো আর কোনোদিন এ দেশে ওর সঙ্গীসাথীদের কাছে ফিরতে পারত না,ঝিনুক ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে।ওতো উদ্বাস্তু হয়ে যেত। কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল বাপি।
          ধীর‍্যান,কিছু কইয়ো না অরে,কাঠের খড়ম খটখট করে মামু এসে দাঁড়ালো। বড়ই মায়াবতী হইছে আমার মায়!যত্ন কইরো মাগোরে। মামু তার মাথায় হাত রাখে।
        কল্লোলবাবু,বাপি আস্তে করে ছোড়দার কাঁধে হাত দিল ,বুঝতে পারছি,পাখিটার জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার।দৌড়ঝাঁপ করে ধরে এনেছিলে।আদর করে কথা শেখাতে..কিন্তু মুশকিল হোল ছোট বোনের কথাগুলোও...যাকগে আসছে শীতে নাহয় একটা কুকুরছানাই পোষা যাবেখন কি বলো?ওই দ্যাখো কত মানুষ এসেছে আমাদের সাথে দেখা করতে। দয়ার সাগর আমার! আড়ালে ছোড়দা মুখ ভেংচে চড় দেখায়। 
           উঠোন ভরে গেছে লোকে।গোটা পাড়াটাই তাদের আত্মীয়কুটুম। হাড়িভর্তি সেদ্ধভাত,মাছভাজা,মোয়ার টিন আর পিঠে নৌকোয় তুলতে তুলতে ছেলেমানুষের মত কাঁদতে লাগল মামু।অগো যাইবার সময় চউক্ষের জল ফালাইও না বলে দিদুন আরও জোরে কাঁদতে লাগল। আইবো মাগো,আবার আইবো।মা আর হেম কাঁদতে কাঁদতে একই কথা বলছিল।সাবধানে যাইও ইন্ডিয়ার থিক্যা আওন যাওন সোজা কামডা না। আর তখন,আরতিদি ফিসফিস করে বললো,ঝিনি,চক্ষু বুজো,,এইবার মুডাডা খুলো আর হাতের মধ্যে একমুঠো রেশমের মত সবুজ এক রিবন। সুন্দার? খুব। আবার আইবাতো? আরতিদি তাকে জড়িয়ে ধরে। ঝিনি দ্যাখে সবার থেকে একটু দূরে গাব গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে সোনামামি আর তার অন্ধ চোখ থেকে জল পড়ছে।
              আজ এত বছর পরে সেইসব শৈশব-কৈশোর-তারুন্যে ভরা দিন মুঠো থেকে ছড়িয়ে গেছে যখন,দেখি পাথরের মেঝে ফুঁড়ে ওঠে রুপোলী মাছের ঝাঁক,হাওয়ায় ভাসে,আমি আঁজলা ভরে জল নিই আর  স্নানজলে নদী দেখি নদী।বুঝি মরা প্রজাপতির রেণু থেকে জ্যান্ত ফুল বরাবর বুকের ভেতরে বসত করে কবেকার নিবিড়  ছায়া মানুষেরা।ঝিনুকের বয়স বাড়ে নাতো।আমি ঠিক সেভাবেই হেসে উঠব,সেভাবেই অঝোর হয়ে যাব,যদি গতজন্মের মত তারা সামনে এসে দাঁড়ায়।শান্ত সেই  জলোচ্ছাসের জন্য হয়ত সকলেরই নদী অপেক্ষায় থাকে। এক জীবনে কত জন্ম পেরিয়ে,সকাল-দুপুর-সন্ধে পেরিয়ে অন্ধকার আকাশ জুড়ে টিপ টিপ রূপোর প্রদীপ জ্বেলে দেয় ছোট হাসির, ছোট খুশির ফেলে দেওয়া সেইসব দিন...
               









1 comment:

  1. ভীষণ ভালো লেখা । ছোটবেলার এমন কিছু ছুঁয়ে গেছেন লেখক , যে সবার ছেলেবেলা ভেসে উঠবে এখানে , উঠবেই । এত নিজস্বতা , এত মনখারাপি বিষণ্ণতা এই লেখায় ... আর একটা কথা বাংলা ভাষা কী মিষ্টি কী সুন্দর হয়ে ধরা দিল এখানে !!

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত? ঋত্বিক ঘটক :   চলচ্চিত্র তৈরির প্রাথমিক লক্ষ্য মানবজাতির জন্য ভাল কিছু করা। যদি আপ...

পাঠকের পছন্দ