Sunday, July 21, 2019

উম্নো আর ঝুম্নোর গল্প -মৌ সেন







আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। ওদের নাম উম্নো আর ঝুম্নো । ভালো  দুটো নামআছে। কিন্তু মা বাবা ওদের ওই নামেই ডাকে। দেড় বছরের ছোট বড় দু বোন। একই স্কুলে ক্লাস সেভেন আর সিক্সে পড়ে । এক খাটে শোয়, পাশাপাশি । রাতে যতক্ষণ ঘুম না আসে গল্প করে ওরা।কত কত গল্প। ইন্দিরা গান্ধীকে তার দেহরক্ষীরা মেরে ফেলেছে, গাওস্কর পৃথিবীর সেরা ক্রিকেটার, শ্রীদেবী বলে দারুণ সুন্দরী এক নায়িকা 'তোফা' বলে একটা সিনেমা করেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক গল্প । আরও একটু ছোটবেলায় ওরা খেলনাবাটি বিছানায় নিয়ে শুতো । এখন আর খেলনাবাটি নেয় না। রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হলে ছোট বোন দিদি কে ডেকে তোলে ' এই দিদি, বাথরুমে যাব'। দিদি ও জানে বোন একা কিছুতেই বাথরুমে যাবে না। ও একা গেলেই নাকি বাথরুমের জানলায় একটা পেত্নি এসে দাঁড়ায় । হিন্দি সিনেমার গল্প শুনলেই তো আর চট করে বড় হওয়া যায় না! ভূতের ভয় আদি অকৃত্রিম ।
 

ওদের একটা দাদা ও আছে, ক্লাস টেন এ পড়ে । দাদা আছে কিন্তু ঠিক ওদের সাথে না। দাদা যেন এক যোজন দূরের কোনো রাজপুত্র । বোনেদের সাথে মানসিক ভাবে যুক্ত না। এক বাড়িতেই থাকে, কিন্তু আবার থাকেও না। তার সব কিছুই বোনেদের থেকে আলাদা। তার আলাদা পড়ার টেবিল,আলাদা বন্ধু,  আলাদা মাস্টার, আলাদা স্কুল, নির্দিষ্ট থালা গ্লাস , এমনকি ডাইনিং টেবিলেও তার একটা নির্দিষ্ট চেয়ার । দাদার কাছে বাবা আর মায়ের অনেক আশা। দাদা কে বংশের মুখ উজ্জ্বল করতেই হবে যে!

উম্নো আর ঝুম্নোর কাছে পড়াশোনা নিয়ে কোনো চাহিদা বা আকাঙ্খা নেই মা বাবার । বরং মা ওদের মধ্যে সব কাজ ভাগ করে দিয়েছে। একজন বিছানা করে, একজন বিছানা তোলে। তিনটে বিছানা। ওরা ছোট ছোট হাত দিয়ে মশারি ভাঁজ করে, নারকেল ঝাঁটা দিয়ে ফটাফট বিছানার চাদর ঝেড়ে টানটান করে পাতে। একজন সকালে ঠাকুরের পুজো করে আর একজন সন্ধ্যে দেয়। ফুল, জল দিয়ে ঠাকুর ঘর পরিষ্কার করে ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে পুজো করতেও ওদের বেশ কিছুটা সময় চলে যায় । এছাড়া হ্যারিকেন মুছে, পলতে কেটে কেরোসিন তেল ভরে সন্ধ্যাবেলার জন্য তৈরি করে ওরা। উনুন ধরায় সকালে আর কয়লার গুঁড়ো মেখে ছোট ছোট গুল দেয় উনুন ধরানোর জন্য । সকালে চা করে বাবা মা কে দেয়। রাতে খেতে বসার আগে জল, জায়গা করে।কাচা জামা কাপড় টান টান করে ভাঁজ করে আলনায় গুছিয়ে রাখে। এত কিছুর মাঝেও কৈশোর এর মাঝামাঝি অবস্থায় জীবন থেকে সব রস শুষে নিয়ে বড় হতে থাকে ওরা । দু বোন, স্কুলে যায় হেঁটে হেঁটে আর যাওয়ার পথে রাস্তা থেকে দেশলাই এর খাপ কুড়িয়ে জমিয়ে রাখে পুরনো একটা জুতোর বাক্সের ভেতরে ।
 
সারা দিনের মধ্যে ওদের সব চেয়ে প্রিয় সময় বিকেল বেলাটা। স্কুল থেকে ফিরে নাকে মুখে গুঁজে দুজনেই দৌড়োয় খেলার মাঠে। আহ্ কি আনন্দ । সব বন্ধুদের সাথে সারা বিকাল খেলে। ছোঁয়াছুঁয়ি, লুকোচুরি, বুড়ি বসন্ত, পিট্টু, আর সন্ধ্যা পড়লেই এক ছুটে বাড়ি । হাত পা ধুয়ে সন্ধ্যে দিয়ে পড়তে বসে। পড়া হয়ে গেলে একজন খাবারের জায়গা করে আর অন্যজন বিছানা করতে যায় । 

উম্নো আর ঝুম্নো মাঝে মাঝে ঝগড়াও করে কাজ নিয়ে । ছোট্ট থেকেই সব কাজ ভাগ করা থাকায় ওরা ক্লান্ত হলে পরস্পরের প্রতি রাগ ঢেলে দেয় । ওদের মা খুব ক্রিয়েটিভ, আর দেখতেও অপূর্ব । কবিতা আর গল্প লেখায় বেশ নাম তার। ।মা যখন আয়নার সামনে বসে ঠোঁটে হাল্কা রঙের লিপস্টিক লাগায় তখন ওরা দুই বোন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। আর নিজেদের গায়ের রঙের সাথে মা এর গা এর রঙে কোনো মিল খুঁজে না পেয়ে ভাবে এটা কি সত্যিই ওদের মা ? মা কে স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরী বলে মনে হয় ওদের ।
 


অন্য মহিলাদের থেকে বেশ এগিয়ে থাকা এই মানুষটাকে দুবোনই খুব ভালবাসে।
মায়ের সব কথা ওদের কাছে বেদ বাক্য। কারণ ওরা জানে, যত কিছুই হোক না কেন, পৃথিবীতে মা এর থেকে বেশি কেউ ভালবাসেনা। তাই মায়ের সব আজ্ঞাই প্রশ্নাতীত।  শুধু মাঝে মাঝে কোনো কোনো দিন খেলা থামিয়ে রেশন আনতে যেতে বললে, মুখ ভার করে মা কে বলে, দাদা যাক না মা , আমরা যে খেলছি ?  মা ওদের বোঝায় অমন বলতে নেই। মেয়েদের কাজ করা শিখতে হয়, ছোট থেকে । তাহলে শশুর বাড়ি গেলে কষ্ট হবে না। ছোট থেকে এই একই কথা শুনে শুনে দুবোনই বুঝে ফেলেছে যে শশুর বাড়ি একটা ভয়ানক জায়গা, যেখানে ওদের একদিন যেতেই হবে, আর গেলে পরিত্রাণ পাবার একমাত্র উপায় ঘরের ও বাইরের কাজ করতে শেখা। অতএব ওরা, সব কাজ করে, তারপর পড়তে বসে। দাদা কে যে কোনদিন কাজ করতে হবে না, এটা বুঝতে পারে ওরা। রাতে বিছানায় শুয়ে হাত, পা যন্ত্রণা হলে ছোট বোন কাঁদে। দিদি বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এই না পাওয়া একটা জগতে, আপাত মধুর কিন্তু অসাম্যের একটা বাড়িতে পরস্পরের অবলম্বন হয়ে ওরা বড় হতে থাকে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় যখন ওদের প্রতি মাসে পিরিওড হয় । সবে শুরু হয়েছে জীবনের এই আর একটা দিক। কিশোরী দুটো বুঝতে পারে এটা একটা কষ্টকর সময় যা চলবে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স অবধি । যন্ত্রণার জিনিস কারণ, এই সময় ছোট ছোট টুকরো করা কাপড় ওরা ব্যবহার করে, যা প্রতিদিন কাচতে হয়, শুকোতে হয় আর স্কুলে যাবার সময় প্যাকেটে করে এক্সট্রা কাপড় নিয়ে যেতে হয় । ওদের বাড়িতে স্যানিটারি ন্যাপকিন আসে, কিন্তু ওদের জন্য নয়, ওদের মা এর জন্য । ওরা একবার বলেছিল ওদেরকেও কিনে দিতে । কিন্তু মা বলেছে ন্যাকড়া ব্যবহার করতে, বলা যায় না কি রকম বাড়িতে পড়বে বিয়ের পর। যদি তখন না পায় স্যানিটারি প্যাড ? তাহলে তো খুব কষ্ট হবে, তাই আগে থেকেই এই ব্যবস্থা ।

জীবনে বড় হবার সময়ে সব চেয়ে কাছের আর নির্ভরযোগ্য যে মানুষ, সে ই যদি নিষ্ঠুর হয় তাহলে জীবনের বেড়ে ওঠাটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটা বিরুৎ গাছের বেড়ে ওঠার মত লতানো হয় । বেড়ে ওঠার জন্য ওদের পরস্পরের অবলম্বন ওরা নিজেরাই। বাড়ির
বেশীরভাগ কাজ দু বোনের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে নিজেরা এক স্বস্তির জীবন যাপন করে সেই মানুষ গুলো, যারা দের আত্মার আত্মীয়। জীবনের নূন্যতম চাহিদা গুলো মেটানোর মত সামর্থ্য থাকা স্বত্বেও ওদের দু বোনের জন্য কোনো সুবিধা দেওয়া হয় না। পাঁচ জনের সংসারে বাবা নির্বাক দর্শক এর ভূমিকা পালন করে। আর মায়ের পরম আদরে হেলে দুলে বড় হয় একমাত্র পুত্র সন্তান, শিবরাত্রির সলতে।

বড় হয়ে দুই মেয়ে বুঝতে পারে না আসলে ওরা দুজন দুটো বন্ডেড চাইল্ড লেবার। শশুর বাড়ি এক অলীক রাক্ষস বাড়ি! অসাম্য আর অন্যায় পাওয়া আসলে শুরু হয় নিজের মানুষদের কাছ থেকে। এটা বুঝতে বুঝতে ওদের সময় লেগে যায় প্রায় চল্লিশটা বছর।

পরিস্থিতি এখন আলাদা । বাবা মা অসুস্থ, আর তাদের সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে সমানে লড়াই করে চলেছে উম্নো আর ঝুম্নো। আর ওদের দাদা
, শিবরাত্রির সলতে,  দূর শহরে থাকে, মাঝে মাঝে ফোনে খোঁজ নেয় মা বাবার।


No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত? ঋত্বিক ঘটক :   চলচ্চিত্র তৈরির প্রাথমিক লক্ষ্য মানবজাতির জন্য ভাল কিছু করা। যদি আপ...

পাঠকের পছন্দ