শহীনের বাড়িতে কোনও আড়াল
ছিল না। এক ঘর থেকে অন্য ঘর আলাদা করার দেয়াল ছিল না কোনও। অনায়াস যাতায়াত ছিল আমাদের। শহীনের বাড়িতে একবার ঢুকে পড়লে অন্তহীন পরিক্রমার চালে
আমরা ভেসে বেড়াতাম। ইরানী ফরাসে এলোমেলো বসে থাকা তরুণ-তরুণী আলিঙ্গনে আপ্যায়ন করত। হাতে ধরিয়ে দিত সুগন্ধী তামাক ভরা গড়গড়ার নল। কখনও তামাকে থাকত কাঁচা আপেলের রেশ, কখনও বা আঙুরফলের মিষ্টি সুবাস। জলের বদলে গড়গড়ায় ভরা থাকত কম দামি শরাব। নেশায় খানিক উপরি রঙ ধরবে, এই-ই!
দু'তিন টানেই পৌঁছে যেতাম রসুইখানায়। ভুরিয়া আর হেসাম বাজার এনেছে। তুর্কীস্তানী বেকারি থেকে কেনা তরতাজা রুটি, ফেটা চিজ আর অলিভ-তেলে ভেজানো নরম
জলপাই। এই দিয়ে সান্ধ্য আড্ডার শুরু। উনুনে চেপেছে গোর্মে-সাবজি আর পিলাফ। মেথি শাক দিয়ে গরুর মাংস আর গোলগোল করে কাটা আলুর উপরে সেদ্ধ
চাল ভাপে বাড়ছে। নৈশভোজের
প্রস্তুতি। আমার ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসে ওয়াইনের বোতল কিম্বা মরশুমি
তরমুজ। কখনও পাড়ার কসাইখানা থেকে সদ্য কেনা মাংস। এইভাবেই, যার যতটুকু সামর্থ্য, বাজার এনে জড়ো করি শহীনের
ঘরে।
এতক্ষণে শহীন ঠিক টের
পেয়েছে, আড্ডায় হাজির হয়েছি আমি। ঘরের যে প্রান্তে শহীনের কর্মশালা, সেখান থেকেই দরাজ গলায় হাঁক পড়ে, 'দিয়া! দিয়া! ঘেরবেদে বিয়া...'
এসো, এসো, আমার
ঘরে এসো।
টালমাটাল শহীনের পদক্ষেপ। এইভাবেই আমরা তাকে বরাবর দেখে অভ্যস্ত। আপাদমস্তক টলটল করছে ভডকার নেশায়। ডান হাতে নিভে যাওয়া সিগারেট। পাশ দিয়ে যেতে যেতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে কেউ। এক মুখ জমকালো দাড়িগোঁফ সমেত জ্বলজ্বল করছে শহীনের
চোখ। ঝলমলে হাসি। শহীন আমাদের বন্ধু। পেশায় ভাস্কর। বিশালাকার এক ব্রোঞ্জের মূর্তী গড়ছে, কর্মশালার এক কোণে তারই প্রস্তুতি। ভিয়েনার ব্যস্ত শহরের চার মাথার মোড়ে বসানো হবে শহীনের
বানানো সেই মূর্তী। গর্ভবতী মা, কোলে পিঠে আরও দুই সন্তান, বুকের পাঁজর বের করে
আগলে রাখবে পৃথিবীর সুন্দরতম শহর।
শহীনের পরনে থাকে ওভার-অল। এক মনে কাজ করার অবসরেই উপস্থিত হই আমরা। আমরা জানি, বাজার করে না দিলে, রান্না করে না দিলে,
শহীন খাবে না কিছুই। আমরা জানি, রোজ রাতে শহীনের ঘরে আমরা গান বাজনা না করলে, নেশায়
ভরে না উঠলে, শহীনের কব্জিতে নেমে আসবেই অসতর্ক ব্লেড। তাই, যে যার কাজের শেষে শহীনের বাড়ি এসে বসি। যে বাড়িতে আড়াল নেই কোনও। কেউ তাকে এগিয়ে দি'
সুরাপাত্র, কেউ দিয়ে যাই বাটি ক'রে গরম ভাত-ডাল। কেউ বা আগুন এগিয়ে দি', কেউ গান ধরি। একটু একটু করে মাটি পড়ে শহীনের কাঠামোয়। শিশুর মত আনন্দে ভরে ওঠে শহীন। প্রতিরাতে। শিল্পের কাছে আমাদের এইটুকুই ঋণ।
আমাদের মধ্যে কেউ পেশাদার
গায়ক, কেউ ছবি আঁকে, কেউ বা পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট। কারুর ক্যামেরার জাদুতে ফুটে ওঠে জ্বালাময়ী ইরান। আমি একা কাঠখোট্টা মাস্টার্স স্টুডেন্ট। শহীনের বাড়িতে ঢোকার আগেই গা থেকে ঝেড়ে ফেলি সকালের
পরিচয়। এখানে সবাই আমার কাছে শুনতে চায় কবিতার কথা। গলা জড়িয়ে নেগর বা নাজলি বলে ওঠে, 'দিয়া-জুন! তোমার বাংলা ভাষার গান গাও একটা!' আমিনা ঘুরে ফিরে
এসে একবার করে বলে যায়, 'মুঝে তুমসে প্যার হ্যায়...'। ওরা শুনতে চায় ভারতের পারস্য সম্প্রদায়ের ইতিহাস। জরথ্রুষ্ট ধর্মাবলম্বী অবশিষ্ট কিছু মানুষের গল্প শুনতে
চায়। এক জগতের ওয়ার্মহোল থেকে বেরিয়ে আমি প্রবেশ করি সম্পূর্ণ
ভিন্ন এক জগতে। অরণ্যের মাপজোখ করে,
বিজ্ঞানের সূত্র নিয়ে তোলপাড় আলোচনা শেষে ইয়ুনিভার্সিটি মেট্রো স্টেশান
থেকে এক পৃথিবী থেকে প্রস্থান করে শহরের সর্পিল পাতালপথ আমাকে এনে পৌঁছিয়ে দেয় শহীনের
আস্তানায়। ওই দরজা আর এক ওয়ার্মহোল। ওপারে অন্য এক জগতের বাসিন্দা আমি। সেখানে আমার মাথায় ওঠে অন্য রঙের মুকুট। দিন আর রাতের স্বাভাবিক ভাগের মত সকালের শিক্ষার্থী
আর সন্ধ্যের শিল্পানুরাগী সত্ত্বায় বিভক্ত হয়ে পড়ি। ক্ষুধার্ত স্পাঞ্জের মত শুষে নি' সৃজনশীলতা। যা চুঁইয়ে পড়ে দিনযাপনে, পেশাদারিত্বে। অনায়াস সাবলীলতায়। যেমন অনায়াসে ঘুরে ফিরে বেড়ানো যায় শহীনের দেয়ালবিহীন
ঘরে।
একটি সন্ধ্যা থেকে অন্য
একটি সন্ধ্যায়, এক রাত থেকে পরের রাতে,
ভিয়ানা শহরে আমি শিখতে থাকি ফারসি সংলাপ। আমার দৈনন্দিন ভাষায় যুক্ত হয় 'খেইলি মামনুন', 'সালাম!
চেতোরি? খুবি? মান
খুবাম!'। 'জান-এ-মন' শব্দবন্ধে যে সকলকেই ইচ্ছেমত সম্বোধন করতে পারি,
এই উপলব্ধির কাছে শান্ত হয়ে বসে শুনতাম মোহসেন নামজু-র গান। শিখে নিতাম 'এ খরেভান, এ সরেভান, লে লয়ে মান খো জো....' গভীর রাতে হাতে হাতে মিলিয়ে,
পায়ে বেসামাল তাল মিলিয়ে আমরা কুর্দিশ নাচে মেতে উঠতাম। ফারিদের বাড়িতে একবার বেড়াতে এলেন মোহসেন। ততদিনে তাঁর অনেক গানই আমার কন্ঠস্থ। মোহসেন তখন পলিটিক্যাল রিফিউজি। ইরানে ফিরে গেলেই তাঁর কারাবাস এবং মৃত্যুদন্ড। অস্ট্রিয়ার সরকারের কাছে তখন তাঁর আবেদনপত্র জমা পড়েছে। এরপরের গন্তব্য উত্তর অ্যামেরিকা, তারপর ক্যানাডা। যেখানে অনুমোদন পাবে আবেদন, মোহসেন সেই দেশের নাগরিকত্ব লাভ করবেন। সেই সন্ধ্যায় আমি মোহসেনের সঙ্গে মোহসেনেরই লেখা গান
গাই। সেই সন্ধ্যায়, মোহসেনের কোনও জাগতিক নাগরিকত্ব ছিলনা। হাতে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের বাদ্যযন্ত্র, চোখে ছিল স্বপ্ন, আর গলায় অফুরন্ত
গান। মোহসেনের সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। এরকমই এক সন্ধ্যায় আমার দৃষ্টি নরম হয়ে আসে ফারিদের
প্রতি। ফারিদ এমনই এক মায়ারাতে আমার জন্য লিখে আনে আস্ত একখানা
গান। পরেরদিন বাড়িতে ডেকে পিয়ানোয় বাজিয়ে শোনায় 'মস্তানেহ' কম্পোসিশন। শহর ছেড়ে আসার দিনে ভিয়েনা এয়ারপোর্টে
বিদায় জানাতে এসে ফারিদ আমাকে বলেছিল, এবং আমিও ফারিদ-কে জানিয়েছিলাম, 'তোমাকে ভারী পছন্দ ছিল আমার,
তুমি আমায় পছন্দ করো কিনা তা' তো বুঝলাম
না...'।
ফারিদের সঙ্গেও সেই আমার
শেষ দেখা।
শহীনের বাড়িতে খাওয়া
দাওয়ার শেষে আমরা দল-বেঁধে বেড়িয়ে পড়তাম পথে। পাশের স্টেশানে ততক্ষণে চলে এসেছে আমির-খাসরো। পাড়ার ইরানী রেস্তোরাঁয় সে গানের দলে তোম্বক বাজায়। সেই উপরি উপার্জন জোগায় কলেজের সেশান-ফি। সন্ধের আড্ডায় আমির আসতে পারেনা নিয়মিত, তাই আমরাই যাই ওর সঙ্গে দেখা করতে। প্রতি রাতেই মেট্রো স্টেশানের বাইরে ধুমধাম করে অভ্যর্থনা
জানানো হয় আমিরকে, যেন কতদিন দেখা হয়নি, সন্ধের আড্ডা ওকে ছাড়া ম্লান, ওর অভাবে দুঃখে আত্মহারা
হয়েই আমরা নেমে পড়লাম রাস্তায়। রোজকার নিয়মিত নাটকের স্ক্রিপ্টে আমির-খাসরো জুড়ে দেয় দু'একটা সংলাপ। এরপর আমাদের পদযাত্রার শুরু। ভিয়েনা শহরে তখন নেমে এসেছে গভীর রাত। জগৎবিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভে ঘেরা প্রস্তরময় ইতিহাসের
ভিড়ে রচিত হয় আমাদের নিষিদ্ধ বর্তমান। এলোমেলো আলোচনা,
টুকটাক রসিকতা, গান, আর স্মৃতিনির্মাণ। অলিগলিতে হঠাৎ সরে যায় ছায়া। হয়ত বা অশরীরী নেকড়ের দল, সেইসব শেয়ালের কায়াহীন ছবি, যারা
একসময়ে শাসন করেছে এইপ রাস্তাঘাট। আমাদের সম্মিলিত হুক্কাহুয়ায় জেগে ওঠে রূপকথা। আধুনিক গ্রিম-ভাই-বোনের গল্প।
এক স্টেশান থেকে পরের
স্টেশানে হেঁটে চলি আমরা, যার যার বাড়ি পড়ে পথেঘাটে,
তারা ঘুমের খোঁজে ঢুকে পড়ে গর্তে। পরবর্তী দিনের অপেক্ষায়।
সেইসব শেয়ালেরা দেশে
বিদেশে ঘুরে বেড়ায় বন্ধুত্বের বেশে।
আহা.. চমৎকার...
ReplyDeleteবাঃ দিয়া
ReplyDeleteChokher samne chhobi dekhlam jeno!!
ReplyDelete