Sunday, July 21, 2019

আত্মজীবনীর ছেঁড়া অংশ-- সুবীর সরকার





চিলাপাতার হাটে ঢোল বাজাতে বাজাতে আমার নিকটবর্তী হয়েছিল জার্মান রাভা।আন্দুবস্তীতে হাড়িয়া খেতে খেতে কত কত বছর আগে জার্মান তার জীবনের নানাকিসিমের গল্প শুনিয়েছিল।কত কত বাদ্যগান মোরগলড়াই কবরখানা ধামসা মাদল!এক ফাঁকে জেনেছিলাম শিবজির বৃত্তান্ত,যাকে গিলে ফেলেছিল মেন্দাবাড়ির হাতি।মাঠে মাঠে ঘুরি।ছড়ানো রোদের মায়ায় ভরভরন্ত শীতকাল।নকসাদার।অপরূপ।প্রান্তিক সব গঞ্জবাজারে উত্তরজনপদের,নিম্ন অসমের নদীজলবাতাসে পুষ্ট হতে হতে কেমন এক চিরকালিনতাই এসে যায় বুঝি।কত সম্পর্কবর্ণময় এক জীবনই তো যাপন করি।
অসমের গৌরীপুর।সাদা ফিতের এক নদি গদাধর।লাওখাওয়ার বিল।৩০০ বলির দূর্গাপূজা।রাজা প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়া।রাজকুমার প্রমথেশলালজি রাজার গল্পগাথা।আর হস্তির কন্যা প্রতিমা বড়ুয়া।জনশ্রুতিতে ‘আজার বেটি’।গৌরীপুরের পথে পথে হাঁটি।পাগলের মত হাতি খুঁজি।সেই সব মাহুতফান্দীদের খুঁজি।আমার শরীর জুড়ে গোয়ালপারিয়া লোকগান।কাঠি ঢোল।মায়াময় এক জীবন নিয়ে আমার গতজন্মের ‘মাটিয়াবাগ রাজবাড়ি’।বিমল মালির বাজনা বাজে,বাজে সীতানন্দের সারিন্দা।প্রতিমা বড়ুয়ার গানের সুরে সুরে আমার আবহমানের অনুভুতিময় স্মৃতিকাতর কুয়াশাঘেরা জীবনের দিনগুলি জীবন্ত হয়ে বেঁচে থাকে।তুমুল এক শীতরাতে রাজবাড়ি থেকে বিমল মালির সঙ্গী হয়ে ফিরছিলাম।বিমল শোনাচ্ছিল প্রতিমার নেশাময় জীবনের হরেক গাথাগল্পগুলি।প্রতিমার জীবন,তার গান,গানময় বেঁচেবর্তে থাকবার আর্তি প্রবলভাবে উজ্জীবিত করেছিল।নাসিরুদ্দিন বিড়ি আর দেশী মদ খতে খেতে হাতিমাহুতের সে এক অন্তহীন পৃথিবী-
   ‘ও তোর মাহুত চড়ায় হাতি/গদাধরের পারে পারে রে’

সে এক অদ্ভূত মানুষ!যার সঙ্গে হয়তো আর দেখাই হবে না কোনদিন।যার জন্য মন কাঁদে,বুকের ভিতর আশ্চর্য মোচড়।রাজশাহী শহরে পদ্মার পারে তার সাথে দেখা।সম্রাট স্বপন।পেশায় রিক্সাচালক।পদ্মাচরে বাড়ি।বন্ধু কবি মাসুদার রহমান ও আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দেখা পেয়ে যাই সম্রাটের।ওর রিক্সায় পরবর্তী ৩ দিন আমরা অন্তহীন ঘুরে বেড়াই।সম্রাট স্বপন ভবঘুরে,উদাসীন স্বভাবের।কিভাবে যেন আত্মীয়তায় বেঁধে ফেলে সে আমাদের।আমরা স্বপনের নদীচরের বাড়িতে যাই।বড্ড মায়াময় এই জীবন।হা হা হাসতে হাসতে প্রবল গান গেয়ে ওঠা সম্রাট স্বপনের।
আবার হেরম্ব বর্মণ কে কি করে ভুলি!সাহেবপোঁতার হাটে,পাটকাপাড়ার হাটে টর্চলাইট বিক্রি করত হেরম্ব।সে ছিল আমুদে,রসিক মানুষ।কোচবিহার রাজার শিকারযাত্রায় হাঁকোয়ালি করত।‘কুষাণ পালায়’ ছুকরি সেজে খোসা নাচতো।আবার হেমন্তের সদ্য কাটা ধানখেতে ঘুরে ঘুরে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান কুড়িয়ে নিয়ে আসতো।হেরম্ব গল্প বলতো,যেন বহুপ্রজ এক কথোয়াল!পুরোন দিনের সব ধনীজোতদার,কোচবিহারের রাজারাণীরাজকুমারেরা কী জীবন্ত হয়ে বর্তমানে ফিরে আসতো যেন।
দিদির মৃত্যুর দিন বৃষ্টির হচ্ছিল।বৃষ্টির ভিতর মৃত দিদির মৃতদেহবহনকারী আমরা।দিদির মৃতমুখ বেদনাবাহী বৃষ্টিকণায় মিশে যেতে যেতে কেমনতর এক শোকগাথা হয়ে দিদিকে নিয়ে লেখা যাবতীয় এলিজিতে গিয়ে ঝাঁপ দেয়।
গল্পের পাকে পাকে,স্মৃতির পাকে পাকে জড়িয়ে যাওয়া জীবন।অথচ কোথাও জায়মানতা থাকে না!নদীতীরের বাতাসে তিরতির কেঁপে ওঠা জীবন।কাঠামবাড়ির জঙ্গল ভেঙ্গে হাতিরা বেরিয়ে আসে,হাঁটতে থাকে গজলডোবার দিকে।আমি বুঝে ফেলি,দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙিলা দালানের মাটি।
৪।
 ‘বাচ্চা বাপই সোনার চান
গরু দুইটা আইলত বান্ধ’
কইকান্তকে রাধাকান্তর দিকে হেলে পরতে হয়।চোখে চোখ রাখতে হয়।জনমভরের এ এক আবশ্যিকতাই হয়তো বা।তাদের অন্তরঙ্গতা দেখে পাখপাখালিরা উড়াল দেয়।সোমেশ্বরী তখন আন্ধনঘরের ভেতর তেলহলুদের এক দিনদুনিয়া নিয়ে পুরোন গল্পের দিকে নুতন গল্পগুলিকেই এগিয়ে দিতে থাকে।এগিনায় হেঁটে বেড়ানো হাঁসমুরগির দল তখন জীবনের জেগে ওঠাকেই যথাযথ করে তুলতে থাকে।গোহালের বুড়ি গাইএর হাম্বা ডাকের সঙ্গে খিলচাঁদ খামারুর চটকা গান মিশে যায়-
‘ওরে ধলা মুরগিটা
বাচ্চা ফুটাইছে
ওরে বগিলা চিলাটা
উড়িয়া রে যাছে’
উত্তরের লোকজীবনের ছন্দে ছন্দে এভাবেই সংসারের মায়া সাজাতে থাকে সোমেশ্বরীরা।বুঝি হলখল কাশিয়ার বন।হালাউ হালাউ দুধের ঘটি।
দিনের পিঠে দিন যায়।শীতের জেগে ওঠা নদীর বিশাল সব চরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ময়নামতী কত রকমের পাখি দেখে।ফড়িং এর পিছে পিচে,প্রজাপতির পাখনায় চলকে যাওয়া সোনা রোদের বাহার দ্যাখে।ময়নার জীবন জুড়ে চারপাশের এই ব্যাপ্ততা একধরনের শুন্যতা এনে দেয়।সে বুঝি বিষাদময়য় মেঘরোদের এক বহতা জীবনকে নিজের সমস্তটুকুর ভেতর তীব্র ভাবে প্রবেশ করাতে থাকে।আর তার শরীরের খুব গোপন থেকে জেগে উঠতে থাকে কেমন এক বুক খালি করে দেওয়া গান_
‘তোমরা যাইবেন অংপুর মইশাল ও
ও মইশাল কিনিয়া রে আনিবেন কি
ও কি বাচ্চা বাপইর নাল বটুয়া
মোরও দাঁতের মিশি মইষাল ও’
গানের ভিতর রংপুর।কোথায় পড়ে থাকছে সেই রংপুর।এত এত দূরে থেকেও ময়নামতি তো গাইতে পারে,নাচতে পারে সেই রংপুরের গানের দোলায় দোলায় ভেসেও যেতে পারে হয়তো বা!সে কি তবে তার মাও সোমেশ্বরীর আন্ধনঘরের দিকে কুয়াশার ভেতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে গেয়েই ফেলে_
‘ও রে অংপুরত হামার বাড়ি
যুবা বয়সের মুই চেংড়ী
কি দেখেন মোর
মুখের ভিতি চায়া’
এতসব ঘটেঘটতে থাকে।আর ময়নার চোখের সামনে ভাসতে থাকে রঙ্গরসে ভরা সেই এক মস্ত শহর রংপুর।

এই সব রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া কতবার।জন্মান্তরের সব ঘাট-আঘাটা।যাতায়াতের গতিপ্রকৃতি থেকে তো কিছু একটা আন্দাজ করে নেওয়াই যায়।বেঁচে থাকবার চৌহদ্দী থাকে যার ভিতরে আকাশমাটির বাতাসতাতাসের এক জীবন।শীত ঘন হতে থাকে।কাঁপন লাগে হাড়ে হাড়ে। আসারিকান্দির দিকে বগরিবাড়ির দিকে পিলখানার দিকে লাওখাওয়ার বিল পেরিয়ে হাওয়ার শব্দ ও শীত বিছিয়ে পড়লে বসন্ত মালির চেতনায় ঘা পড়লে সে স্মৃতিময় হয়ে উঠতে থাকলে গধাধরের উপর পাখিদের ছায়া পড়ে।বসন্ত মালি টলমল পায়ে তার জন্মান্তরের ঢোল,ঢোলের কাঠির কাছেই আশ্রয় নেয়।যাপনের টুকরো টাকরা দিয়ে কি আর গোটা এক জীবনযাপনকে স্থিরতর করে দেওয়া যায়!বসন্ত খুঁজতে শুরু করে ব্রহ্মপুত্রের ছোট ছোট চর,হ্যাজাকবাতির আলোয় ভরভরন্ত সব গানবাড়ি,নাচুনির দলবল।চরাঞ্চল বনাঞ্চল বাইচের নাও জাফর ব্যাপারির ধনদৌলত পান্তাভাত আর শুটকীসিদোলের আখ্যানগুলি দিয়ে বসন্ত মালি কেমন দূরাগত হয়ে উঠতে থাকে আর নিজেকে এগিয়ে দেয় মস্ত এক উপকথার স্মৃতিবিস্মৃতির ভিতর!শীতরাত ভোরের দিকে গড়ায়।পাছা রাত্তিরের মোরগ ডেকে উঠলে বসন্তের তো আর কিছু করার থাকে না।দূরদেশ থেকে যুবতী কইন্যার গান উড়ে আসে-
   ‘গনেশ হাতির মাহুত রে
   মোক নিয়া যান বাপভাইয়ের দ্যাশে’

‘খুটার বন্দুক ফোটে না’
#
সে কি আসলে ভয় দেখাতে চাইছে!আতঙ্কিত হবার সুযোগ সেভাবে না থাকলেও পূর্ববর্তী দিনকালগুলিকে উদাহরণযোগ্য মনে হতেও পারে।হরিচরণ আর বুড়াবাবুর দ্বন্দ্বসংঘাতকে উচ্চমার্গীয় স্তরে নিয়ে গেলেও আসলে কোথাও কোন গুলির শব্দ নেই।তবে বন্দুক আছে।বন্দুকবন্দনার জন্য ফাঁকা মাঠের জুলুস আছে।বুড়াবাবুর কেশর ফোলানো ঘোড়া কখন যেন ছুটে আসে পাটখেতের অন্তরাল থেকে।‘বন্দুক হাতে রায়সাহেব’-মহার্ঘ ছবি হয়ে ঘুড়ে বেড়ায় জোতজমির সুজলা সুফলার প্রাকৃতিক প্রাত্যহিকতায়।রহস্যের মায়ামাখা সেই বন্দুক প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠতে উঠতে বর্ষাশীতহেমন্তের দিনগুলিকে আত্মগত করতে থাকলে বিলখালের মাছেরা পাশ ফেরে নুতন খাতে প্রবাহিত জলধারায় আকুলিবিকুলির জেগে থাকবার দৃশ্যময় বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনবার প্রয়াসটুকুন নিয়ে পুরাকালীন কোন যুদ্ধক্ষেত্র যেন জীবন্তভাবেই জীবিত হয়ে ওঠে!হরিচরণের হাতে হাতে হেন্তালের লাঠি।উলটে যাওয়া কচ্ছপকে সোজা করতে করতেই তার আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে আসে।বুড়াবাবুর টাড়ির দিকে বিকেলের শেয়ালেরা।
বন্দুকের জং ধরা ট্রিগারে ক্ষয়াটে আঙ্গুল রাখলেও হরিচরণকে মোটেও বয়োবৃদ্ধ মনে হয় না।বন্দুকের রহস্য ভেঙ্গে দিতে চাইলেও কোথাও বুঝি কপট এক আড়াল। রক্তপাত হাহাকার পলায়নের তাড়সে কাঁপতে থাকলেও বন্দুক কিন্তু ফোটে না। ফাটে না।গুলির শব্দের ধ্বনি প্রতিধ্বনি মিথ্যে মনে হয়।বন্দুকের গল্পটিও হরিচরণ তার উত্তরকালের হাতে বাধ্যতই সঁপে দেন!

৫৭।
‘কি গান শোনালু বাপই রে’
#
হাহাকার ভরা পাথারবাড়ি থেকে ধুতুরার ফুল নিয়ে ফিরছে আলিজান মিঞা।নয়ারহাট জোড়শিমুলি কেশরীবাড়ি টপকে টপকে কন্ঠে গান গান নিয়ে সর্বাঙ্গে নাচ নিয়ে জলঢাকার চরে শেষতক তাকে প্রবেশ করতে হবে আর খন্ড অনুখন্ড দিয়ে আলিজান মিঞা নিজের মতন সাজিয়ে নিতে থাকবেন বৃত্তান্তের পর বৃত্তান্তই
রাধাকান্ত কইকান্তকে ইশারা দিতেই কইকান্ত দেখে ফেললো আবারো দুই কুড়ি সাত বছর বাদে দিনদুপুরেই জমে ওঠা মস্ত এক গানবাড়ি।মেলা মানুষজন।ঢোলকাশিবাঁশিদোতোরার সুরে সুরে বাদ্যবাজনায় ভরে ওঠা।নানান রঙের রঙ্গীলা দালানবাড়ি যেন।তখন দূরের সেই দলদলির হাট মুছে যেতে থাকে।গরুর গাড়ি থেকে নেমে পড়ে কইকান্ত আর রাধাকান্ত।তারা পরম বিস্ময়ে দেখে ফেললো এত এত দিন,এত এত সময় পেরিয়ে তাদের থেকে মাত্র হাতকয়েক দূরেই দাঁড়িয়ে আছে কুদ্দুস আর ইয়াসিন।পরস্পরের মুখোমুখি হতেই হল তাদের।কিছুটা সময় এই দুনিয়ার কোথাও কোন শব্দ নেই।তারপর কইকান্ত আর রাধাকান্তর বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো কুদ্দুস আর ইয়াসিন।সে এক বারংবার রচিত গল্প।গল্পের পাকে পাকে এ এক চিরকালিনতাই বুঝি!ভরা দুপুরের সেই গানবাড়িতে তখন গান বাজে,বাদ্যের বাইজনের সাথে নাচতে থাকে সোমেশ্বরী হলদীবালা ময়নামতী_
‘বারো মাসে তেরো ফুল ফোটে
বছরে ফোটে হোলা সই
তোমরা না যাইও যাইও
না যাইও সই লো
ওই না যমুনার জলে’
উত্তরের পথে পথে টাড়িতে টাড়িতে এভাবেই আবহমানের সব আখ্যান রচিত হতেই থাকে।আর সেই আখ্যানের গায়ে মিশে যেতে থাকে আমার আত্মজীবন।













No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত? ঋত্বিক ঘটক :   চলচ্চিত্র তৈরির প্রাথমিক লক্ষ্য মানবজাতির জন্য ভাল কিছু করা। যদি আপ...

পাঠকের পছন্দ