Sunday, July 21, 2019

আত্মজীবনী ও একটি খেলা- অনির্বাণ ভট্টাচার্য







আমাদের আই.পি.এল ছিল না। রাজু ছিল। ভেঙ্কটপতি রাজু। ছোটবেলার ডাউন দ্য মেমরি লেন ধরে বাঁহাতে স্পিন করতবলটা যাব না যাব না করেও ঢুকে যেত অপরাধবোধ আর বনেদিয়ানার সেই নাইন্টিজে। ওপাশে ডেভিড বুন প্রেমিকার বাবার মতো চেহারায় বসে থাকতেনপাড়ার রোয়াকে। কোনও বেপাড়ার ছেলে সদরের দিকে তাকালেই দেখে নেবেন। বাবা সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরত। ইন্ডিয়া জেতার মতো আনন্দ হতপ্রায় শুনশান শহরতলির গলিতে কাঁসার থালা আর একটা খুন্তি নিয়ে একার সেলিব্রেশনের মতো আনন্দ হত। ক্রসওয়ার্ড পাজল। একের ওপর-নিচে ইয়র্কার দিল ইউনিস অথবা, পরপর তিনটে বলে আকিব জাভেদ তুলে নিল তিনজনকে। দুইয়ের পাশাপাশিতে বয়স, টাইম ল্যাপ্স আর পারিবারিক লোহালক্কড় সরে যাওয়ার শব্দ। মাঝে নীরবে দাঁত খুঁটে যাচ্ছেন শচীন। পেছনে অনেকে আছে। সামনে কেউ নেই। দাদু, ঠাকুমা – একটা প্রজন্মের দূরতম দ্বীপের মানুষ। একসঙ্গে সবাই আছেন। আলাদা আলাদা কেউ নেই। একজন গেলেই পরপর। প্যানেল। শচীন কতক্ষণ টানবেন? শেষ অবধি?
শেষ বলতে ক্লুজনার মনে পড়ে। ফ্লেমিং আর অবিশ্বাসের মাঝে কোনও কিছু না দেখেই দৌড়নো একজন যোদ্ধার ভেতরটা আমাদের দেখতে দেওয়া হয়নি। বলা হয়নি গট আপের বাইরেও একজন হ্যান্সি থাকে, যে আম্প্যায়ারের বিরুদ্ধে গিয়ে ডেকে আনে বিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে। জোহানেসবারর্গে প্লেন ধরার আগে বোনকে ফোনে বলে যায়, ‘আই লাভ ইউ হেস্টার’আসল গট আপ ক্রিকেটের বাইরে। যেখানে একটা বড় ঘর ভেঙে কয়েকটা ছোট ঘর হয় জাস্ট শুধু একদিন সবকিছু ভেঙে একটা বড় ফ্ল্যাট হবে – এই ফোরসি থেকে গট আপ। ঠিক করা। ঠিক কে করেছিলেন? বাবাদের লিনিয়েজের কেউ? দাদু? নাকি তারও আগে আমাদের কোনও নিয়ানডারথাল প্রিডেসেসর? বলতে পারব না। কারণ ততক্ষণে আমি চলে গেছি হিথ স্ট্রিকের লাইন লেংথ আর জিঙ্ক অক্সাইডের দিকে। ক্রিকেটে না, আসলে আমাদের ভেতরটাই জন্ম থেকে দূরে সরে আসার ডেস্টিনি মাখা আমাদের অসম্ভব বনেদিয়ানা মুখে রোদ লাগবে বলে পরে নেয় সাদা পাউডার, আমরা দূর থেকে বলে দিই কোনটা ম্যাকডারমট, কোনটা ডোনাল্ড আর কোনটা পল রাইফেল।
রাইফেল নিয়ে কথা হচ্ছিল। বন্দুক। পিস্তল। কার দিকে? গঙ্গার একটু দূরেই আমাদের চওড়া রাস্তার ওপরে বাড়ি, ট্রেন থেকে মেন লাইনের ছাদ আর বারান্দাগুলো আমার হাত ধরা বাবার হাতের উত্তাপে গলে গলে যেত। বাড়ি ফিরে দেখতাম, আজহারের দিকে তাকিয়ে ছলছল করে প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটছেন কাম্বলি। ব্যাগ, বইপত্তর আর বন্ধুস্মৃতি গুছিয়ে নিয়ে আমরা শহরতলি থেকে গুটিয়ে নিচ্ছি সংসার, দূরের মফস্বলে অন্য বন্ধু, অন্য ড্রেসিং রুম, অন্য পপিং ক্রিজ। কল করে মাঝপথে থেমে গেল বড়রা, ততক্ষণে জন্টির ডিরেক্ট থ্রো থেঁতলে দিচ্ছে উইকেট আর আমরা ছোটরা ক্রিজের মাঝে দাঁড়িয়ে কলকাতার বাসের মতো ভাবছি, পেছনের দিকে এগোই।
এগোনো সহজ ছিল না। নতুন বাড়ি, স্কুল আর প্রশ্ন বিচিত্রার ভেতর নেমে আসত বারবার ফোন আসার হ্যালুসিনেশন। আঙুল আর হিউমরের মধ্যে তখনও দাঁড়িয়ে থাকা ডিকি বার্ড, ডেভিড শেপার্ড। কমেন্ট্রিতে হেনরি ব্লোফিল্ডের মতো ক্রমশ বুড়ো হওয়া একটা প্রজন্ম। ঘিরে ঘিরে ধরা ব্যারি রিচার্ডস, বয়কট, টনি গ্রেগ – যাঁদের গলা শুনে আন্দাজ করতাম এককালের তরুণ মুখগুলো। যেখানে ক্যারি প্যাকার আছে, প্রলোভন আছে, তবু তার চেয়েও বেশিরকম আছে শুধু পাঁচ পাঁচটা দিন আর লাল, অসম্ভব লাল একটা বলের কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা। হাত, পাল্টা হাত, ছোঁয়া, উত্তাপ। মাঠের দুই এন্ড থেকে সেন্টিনেলের মতো পাটা পিচের দেশের দুর্গ সামলাচ্ছেন শ্রীনাথ-প্রসাদ। পা ঠিক জায়গায় রেখে চোখের নিচে কালো রঙের কী একটা পরে ডিফেন্স করছেন চন্দ্রপাল, আমরা নন-স্ট্রাইক এন্ডের দিকে তাকিয়ে ভাবছি কিভাবে ইন্ডিয়া পেলেই জ্বলে ওঠেন কার্ল হুপার। গরমের ছুটি। পুজো। যেভাবে আমাকে পেয়ে জ্বলে উঠতেন ঠাকুমা, একটা বন্ধুত্বের নাম ধরে ডেকে যার খাটে গিয়ে লম্বা শোওয়া এবং তখনও টিকে থাকা দূরদর্শন আর স্যাঁতস্যাঁতে সবুজ কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে কেটে যাওয়া আমার, আমাদের সেইসব অ্যানালগি ও অন্যান্য প্রস অ্যান্ড কন্স। গুগলি বুঝতাম না, চায়নাম্যান বুঝতাম না, শুধু বুঝতাম ওয়ার্নের বল এদিক থেকে ওদিকে ঘোরে, সাকলেইনের ওদিক থেকে এদিকে। দুই রুপোলি চুলের মানুষ-মানুষীর ভেতর আমি, অনেকটাই অপরিণত আমি একটা খেলা চালাতাম। যেখানে তিনজনেই জিতবে। ত্রিদেশীয় সিরিজ। আমাদের ট্রায়োটা ভাঙার পর থেকে ত্রিদেশীয় সিরিজটাও কমতে থাকল। আর ছিল, হিরো কাপ। আমাদের সেইসব দিনরাত্রির ভেতর একটা সেমি। কপিলদেবের বয়স, শচীনের আঙুল আর তীব্র বনেদিয়ানার টপ ফর্মে দাঁড়িয়ে কুম্বলের বল। না ঘুরুক, তবু ওই ডেলিভারিটা, উচ্ছ্বাসটা আমার।
আমার বলতে আরও অনেক কিছু ছিল। রোশন মহানামার ব্যাটিং। দারুচিনি দ্বীপের ভেতর বাবার পছন্দের অসম্ভব টেকনিকাল ডিসিলভা আর আমার চকচক করে জ্বলে ওঠা জয়সূর্যর চোখস্বপ্নের ভেতর ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে ‘সানাথ জায়াসুরিয়া’ওপাশে কালু। দাদুর সেই পড়ে যাওয়াটা। প্রভাকরের একটা ওভারের মতো। সব যেন শেষ করে দেওয়া। শুরু। মৃত্যুবোধ। রমন লাম্বা। স্বপ্নের ভেতর ঢুকে গিয়ে দুজনকেই হেলমেট পরাই। এই বয়সে কেউ একা হাঁটে? অত সামনে খালি মাথায় কেউ ফিল্ডিং করে? তাড়া? এত তাড়া? দাদু যেখানটায় পড়েছিল ওখানেই পাড়ার একটা কুকুর মরে পড়ে ছিল। দুজন লীন হয়ে গেল, মনে হয়। টাইম-স্পেস। যেভাবে লাম্বা মিশে গেছিলেন ফিল হিউজের শরীরে। পরে, অনেক অনেকদিন পরে। যখন মাইকেল বিভান ক্রিজে পড়ে থাকতে থাকতে এক সময় খেলা ছেড়ে দিয়েছেন। যখন লর্ডসের ব্যালকনি অনেকদিন হল আর মাড়াচ্ছেন না ফেয়ারব্রাদার, থর্প, আথারটন। যখন স্টিভ ওয়া আর উদয়নের ভেতর ফ্যালফ্যাল চোখে পড়ে আছে কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে আর ব্যাগি গ্রিন। যখন লারা না শচীন, লারা না শচীন এই ফিসফাস পাল্টে জায়গা করে নিয়েছে রাজনীতি। দেশ। দুটো ধর্ম। কে বড়? কারা?
এইসব স্রোতের ভেতর পাড়াতুতো আত্মীয়, বৃদ্ধ কিংবা তরুণ কেউ অস্বাভাবিকভাবে চলে যেত। বন্ধু চলে যেত। আর, আমাদের আস্কিং রেট হুহু বাড়ত। কারণ, তখনও ভাগাভাগির খেলাটা আমাদের রপ্ত হয়নি। কারণ তখনও পাওয়ার-প্লে আসেনি। তখনও ওভারে ছয়ের ঘরে রানরেট রাখার চিরাচরিত শৈশবে এঁদের সঙ্গেই গ্লাভসে গ্লাভস ঠেকানোর কথা ছিল আমার। না জিতি, যেন না হারি। যেন শেষমেশ জাদেজা আর রবিন সিং আমাদের ম্যাচে ফিরিয়ে আনেঠাকুমা পৃথিবীর শেষ স্টেশনের মতো পড়ে ছিল। জানতাম যতই পারফেক্ট পুল করুন, কলার তুলুন ক্লাসিক অহঙ্কারে, পন্টিং একদিন খেলা ছাড়বেনই। অসম্ভব অনাড়ম্বরপূর্ণ কোনও এক ম্যাচে শেষবার মাঠে নেমে কভার ড্রাইভ করবেন দ্রাবিড়। শ্রীনাথ আর প্রসাদের বলে ফিফটি ফিফটি আউট আর বাউন্ডারির দোলাচলের মনোটনি ছাড়িয়ে ক্রিকেটের অনেক বাইরে চলে যাবেন সৈয়দ আনোয়ার। আমির সোহেল অদ্ভুৎ এক স্টান্সে পনেরো ওভারে একশ তুলে দিয়ে ক্রমশ বিস্মৃতির অতলে হারাবেন। একটা সীমানা, একটা বয়স, একটা সময় সব ক্রিকেট, সব ছেলেবেলা, সব গল্প ভেঙে তছনছ করে দেবে ...
আর আমি স্বপ্ন দেখব সেই ভাঙ্গন বেশিদিনের জন্য হবে না। আমার বন্ধুদের, বাবাদের হাসির দমকে পাত পেড়ে খেতে বসবে আমাদের একান্নবর্তী সময়। একটা রিভার্স সুইপে জিম্বাবোয়ে আবার ক্রিকেটের আলোয় ফিরে আনবে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের মতো দেখতে একটা মুখ। আক্রমের সুইঙের ভেতর মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকবে আমাদের সন্ততিরা। ভুল আউট হলে ফেরত আনবে বিপক্ষের ক্যাপ্টেন। হ্যামস্ট্রিং-এ চোট পাওয়া বনেদিয়ানাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে স্লিপে ঝাঁপিয়ে পড়বেন মার্ক ওয়াএকটা বন্ধুত্বের ম্যাচে দুই প্রজন্মের শেক হ্যান্ড হবে। আমাদের সন্ততিদের সঙ্গে দেখা হবে পিতামহীর। ‘আহা, ঠিক যেন বাবার মতো দেখতে হয়েছে। বোস, দুটো নারকেল নাড়ু বানিয়ে দিই’ ময়লা শাড়ির আঁচলের মতো বিমূর্ত হয়ে যাবে দেশ কাল গন্ডীএকটার পর একটা সিংগ্লস নিয়ে গ্যালারির দিকে তাকিয়ে উড়ন্ত চুমু দেবেন রনতুঙ্গা-ইঞ্জামাম। শন পোলকের অক্লান্ত নাইন্টিজের ঘাম ভিজিয়ে দেবে দুহাজার উনিশের ঘাস। ভারত খেলবে। আমি দেখব। ওয়ালস-অ্যাম্ব্রোজের দ্বীপপুঞ্জের ভেতর, স্টিফেন ফ্লেমিং-এর কালো পোশাকের অপূর্ব সুন্দর মিথের ভেতর, সিমকক্স-ম্যাকমিলানের টেবিল পাহাড়ের ফিল্ডিঙের ভেতর ভারত, ভারতের ভেতরে-বাইরে আরও অনেক ভারত খেলবে। আমাদের লোহার সিঁড়ি, পাড়ার রোয়াক, ডেথ প্যানেল, অশ্বত্থ গাছ, গঙ্গার হাওয়া, স্কুল বদল আর বয়সী প্রেমিকার ভেতর এক লক্ষ ইডেন গার্ডেন্স আর অজয় বসু কাঁপিয়ে ভারত একদিন খেলবে। সীমান্ত, সন্ত্রাস, আর সার্জিকাল স্ট্রাইকের বাইরে গিয়ে ধ্রুপদী ভারত খেলবে। জিতবে। জিতেগা ভাই জিতেগা, সেদিন সত্যিই, ইন্ডিয়া জিতেগা ...

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত? ঋত্বিক ঘটক :   চলচ্চিত্র তৈরির প্রাথমিক লক্ষ্য মানবজাতির জন্য ভাল কিছু করা। যদি আপ...

পাঠকের পছন্দ