Sunday, July 21, 2019

সকলি গরল ভেল -- এলা বসু


 



কে জানিত আসবে তুমি গো অনাহূতের মতো... " এই গানটাই মনের মধ্যে বেজে চলেছে। এখন কেমন ভার হয়ে বসেছে। বিরল স্তব্ধতার ভার। এমন অভ্যাস বশে দুম করে প্রত্যাখ্যানটা না করলে কি ক্ষতি হত শুনি? এই "না " বলার পর থেকেই উন্নাসিক ছেলেটার ধারালো চেহারাটা চোখে ভাসছে। 

এই অদ্ভুত একটা দুনিয়া যে আছে, বাংলা মিডিয়ামে মেয়েদের স্কুলে পড়া বৃষ্টির ধারণার বাইরে ছিল। ছোট থেকেই চুপচাপ, শান্ত মেয়েটা মনের ভাব গোপন করতে পারত না। মফস্বলের মেয়ে তো, খুব কায়দা কানুন করা মহিলাদের দেখলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। তবে ওই আত্মীয়স্বজন, ভাই বোন, পাড়া প্রতিবেশীদের কথায় বুঝত, মানুষ তাকে সুন্দর ভাবে। অহংকার ও যে ছিলনা তা নিয়ে একটু আধটু এমনটাও নয়, কিন্তু তা বলে এরকম?? 

কলেজে পা দিয়েই দাদাদের কৃপায় বিখ্যাত হয়ে গেল,  সাথে সাথে দাদার বান্ধবীদের চোখের  বিষ হয়ে গেল. এখানে এক অদ্ভুত নিয়ম চলে,  প্রত্যাখ্যাত হয়েই এরা পরেরদিনই নমো নমো করে আরেকজনকে প্রস্তাব দেয়। এখানে বিজোড় সংখ্যা বেশ, বেশ কম। একা একটি মেয়ে, বহু মানুষের আকাঙ্খার পাত্রী, একা থাকবেটা কেন শুনি?  লাগ পিছনে... ছেলেরা নয় শুধু, মেয়েরাও ওর এই ভাবধারা সহ্য করতে পারে না। বলা হয় সে নাকি নিজের ইমেজ বজায় রাখতেই এই স্ট্যান্ড নিয়েছে, হাতে স্তাবকদের লিস্ট নিয়ে ঘোরে। এমনিতেই চুপ, আরো চুপ হয়ে গেল। ছোটবেলা থেকে শিখেছিল বেশি কথা মানেই বাচালতা,  তাই কথা একরকম বলতই না। কলেজে পা দিয়েই দুজন সহপাঠী পরপর দুদিন প্রস্তাব দিল,  প্রথম দিন না হয় তবু একরকম গেল, দ্বিতীয় দিন কেঁদে কেটে একসা, এরা সকলেই তো আর কথা বলছে না,  তাহলে কাদের সাথে গল্প করবে? এত স্তাবকের ভিড়ে খুব অস্বস্তি হত, একটা অবলম্বন খুঁজছিল তীব্র অভিমানে... কোনো ছেলেরই কি আমাকে বোন মনে হতে নেই? এমন সময় এক  ঝলক  মুক্ত হাওয়ার মতন পেয়ে গেল " দাদাভাই " কে। দুর্দান্ত স্মার্ট, যে কোনো কাউকে মুরগি করত যাকে বলে চুটকি বাজিয়ে,  যেমন ছবি আঁকে,  তেমন ফটোগ্রাফি,  আর ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট আর ক্যান্টিন পুরো মেতে ওঠে তার গানে। এই দাদাভাই নাম দিল " মিষ্টি "।  সে আর তার বান্ধবী সিক্তা  দুজনেই আগলে রাখত বৃষ্টিকে। মোটামুটি সকালেই ট্রেনে খবর পেয়ে যেত, আজ কে প্রস্তাব দেবে, আর সিক্তাদির শেখানো বুলি মুখ নীচু করে বলে সেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেত সেদিনের মতন। গতে বাঁধা বুলি ছিল " দেখুন,  আমার পক্ষে সম্ভব নয়,  মার্জনা করবেন " গল্প  কমেডির দিকে টার্ন নিলেও তেমনটা লিখতে চাইনি। 

 তো,  যার উদ্দেশ্যে গানটি গুনগুন করা, তিনিও কিন্তু কম গুণধর নন। যেমন ভায়োলিন, তেমন কবিতা, তেমন সুন্দর হাতের লেখা, তেমন পড়াশুনোয়। নাম সায়ক সেন।

এক বছর পর সেই অনাহূতের জন্য  দুঃখে ঘোর লেগে গেল। এমন কষ্ট মানুষ মানুষকে দিতে পারে?  নিজের কল্পনায় তার মুখ যেন সর্বদা শুকনো দেখত বৃষ্টি। জীবনের সমস্ত সাহস একত্রিত করে বসল চিঠি লিখতে, জীবনের প্রথম প্রেমপত্র। যদিও তাতে সমস্তটা জুড়েই শঙ্খ,  শক্তির কবিতার ছড়াছড়ি,  অনেকটা বিরিঞ্চিবাবার বুঁচকিকে লেখা চিঠির মতন,  নিজের ভাষা প্রায় কিছুই নেই। সে যা হোক, বান্ধবীদ্বয় বিশাল সাহস যোগালো,  একজন বলল,  "নো চান্স নো গেইন "।  ব্যস,  দুরুদুরু বক্ষে একদিন দিয়েই ফেলল চিঠিখানা। 

সেদিনই, ফিরতি পথে,  স্টেশনে দাঁড়িয়ে বান্ধবীরা বলল,  " দ্যাখ দ্যাখ,  ওরা যেন কিছু একটা কথা নিয়ে খুব হাসাহাসি করতে করতে আসছে,  দাদাদের গ্রুপটার সেই "আর ধরে না " গোছের হাসি দেখে হাত পা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছিল তার। 

শত্রুর অভাব ছিল না যেমন,  শুভাকাঙ্খীও ছিলনা এমন নয়। বৃষ্টির পাশের পাড়াতেই যে সিনিয়র দাদা থাকে, সে কিন্তু সায়ক এর ব্যাচ। তার বাড়িতে বৃষ্টির যাতায়াত আছে, বৃষ্টির বাড়িতেও সেই দাদা আসে। সেই দাদা সন্ধেবেলা বৃষ্টির বাড়ি চলে এল।  তার থেকে যা জানতে পারল, তা না জানাই সারা জীবনের জন্য ভালো ছিল। তার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র জেরক্স হয়ে বিলি হয়ে গেছে ছেলেটির বন্ধুবান্ধবের মধ্যে।  সায়কের দুই বান্ধবীর সেই চিঠির কবিতা গুলো এত ভালো লেগে গেছে, তারাও আর হাতে হাতে পাওয়ার পর হাতছাড়া করতে চায়নি। সেদিন সায়কবাবুর  রাজার অহংকার, তাকে আর পায় কে?  ইউনিভার্সিটির হার্টথ্রব, যাকে কেউ কখনো গলাতে পারেনি, সে কিনা... 

দু একজন আড়ালে বলছে ষাঁড়ের সামনে লাল রুমাল ধরার মতন হাস্যকর কাজ কেউ করে?  ওই সাংঘাতিক ছেলেকে একবার ফিরিয়ে দেওয়ার পর কি করতে আবার ডেকে আনা?  

পরেরদিন দুই বান্ধবীর হাত ধরে ক্লাসে ঢোকার মুখে ফচকে সহপাঠীর মুখে অদ্ভুত ফিচেল শয়তানির হাসি লক্ষ্য করল বৃষ্টি। ক্লাস তখনো শুরু হয়নি, বান্ধবী হাতে ঈষৎ চাপ দিল।  পিছনের বেঞ্চ থেকে তাদের কানের পাশে চিঠিটা পড়া শুরু হয়েছে ... 

"দিল যো  টুটা তো কই হাথ দুয়াকো  উঠে,  এইসে মাহালমে আব কিসকো পরায়া সমঝু?" হ্যাঁ,  এই ক্ষণ যেন পরেও বার বার এসেছে বৃষ্টির জীবনে। যাকে পাওয়ার জন্য এত আয়োজন, তা যখন মিথ্যে হয়ে গেল, কত সহমর্মী পাশে চলে এল। কত বন্ধু হাত বাড়িয়ে দিল। পরেরদিন ট্রেনে সায়ক এর ক্লাসমেট দিদিরা,  ওকে যারা বরাবরই খুব পছন্দ করত, প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিল বৃষ্টির চিঠির।  তারা ওর ফ্যান হয়ে উঠেছে।  এমন সব কবিতা তারা আগে পড়েনি,  হারাতে চায় না... কিন্তু পাশের পাড়ার দাদাটি এনসিওর করেছিল যে কারুর কাছে আর সেই চিঠির জেরক্স নেই, সকলে ছিঁড়ে ফেলেছে।  পৃথাদি বলল "ওমা ! তোর টিপটা খুলে পড়ে গেছে তো ! দাঁড়া, আমার ব্যাগ এ আছে " বৃষ্টি বরাবরই দিদিদের বাধ্য মেয়ে,  কালো টিপটা পরে নিল চুপচাপ। 

এক সিনিয়র দিদির সাথে সায়ক এর সম্পর্ক অনেকদিনের,  সকলেই জানে সে কথা বৃষ্টি ছাড়া। চোখ কান বন্ধ রাখা  মানুষদের যেমন হয় আর কি  !  সেই দিদি তার সাথে সায়কের চূড়ান্ত প্রতারণার গল্প বলল,  কিভাবে তার কিনে দেওয়া শার্ট পরে অন্য মেয়ের সাথে প্রেম করতে চলে গেছে সায়্‌ক, এরকম আরো অনেক গল্প। কিন্তু যে কথাটা সারা জীবনের মতন মনে রয়ে গেল সেটা হল " কাঁদবি কেন?  নিজেকে বোঝা,  এমন একটা মানুষের জন্য এক বিন্দু সময় ও নষ্ট করা অন্যায়,  শুধুই সময় নষ্ট " এটা গেঁথে গেছিল মনে,  কিন্তু আতঙ্ক যায়নি,  সেই সায়ক আবার তার বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে পোস্টকার্ডে কায়দার প্রেমপত্র পাঠায়। প্রসঙ্গতঃ বলা ভালো,  চিঠিটা বাবার হাতে পড়ে,  এমন কায়দা করে লেখা, বাবা কিছু বোঝেনি । ( এক ফোঁটা বাড়িয়ে  বলছি না,  টিভিতে সিনেমা চললে, মাঝখানে এসে বাবা জিজ্ঞাসা করবেই করবে নায়ক নায়িকাকে দেখে,  " এরা ভাই বোন, না? " বরং বলে উঠল... " কে রে ছেলেটি?  কি হাতের লেখা দেখেছিস?" বাড়িতে ল্যান্ডফোন এলে ল্যান্ডফোনে ফোন করে ডিসটার্ব করত। কখনো সামনে মা, দিদা বসে গল্প করছে হয়ত। কোনও কড়া কথা বললেই তাদের নজরে পড়ে যাবে। সায়ক নামটা বৃষ্টির কাছে দাউদের থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু,  রিসিভার ধরে সেই ভয়ঙ্কর হিসহিসে গলা শুনতে শুনতে পায়ের তলা থেকে মাটির সরে যাওয়া অনুভব করেছে। ফোন এলেই আতঙ্ক ! তখনো সে কড়া গলায় কঠিন কথা বলতে শেখেনি। তাই মৌনতার বেশী কোনো ভাষা জানত না ওই প্রান্তের প্রাণীটিকে নিরস্ত করার।  যাদের কাছ থেকে সায়ক তার  বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর জোগাড় করছিল,  তাদের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে।

কিন্তু সেই দিনগুলোর ভয়ঙ্কর স্মৃতি কখনো এক চুল সরেনি, ওই নামটিতে  আতঙ্ক, প্রেমপত্রের নামে আতঙ্ক, সেই কবিতাগুলির প্রতি তীব্র অনাসক্তি, এমনকি ইউনিভার্সিটির লোকজনের থেকেও বরাবর সে দূরে সরে থেকেছে। অবচেতনে বসে থেকেছে এক কেউটে সাপ, কালো একটা ছোট্ট বাক্সের মধ্যে, তালাবন্ধ অবস্থায়। তবু তার হিসহিস শব্দটা পরিস্থিতি বিশেষে জানান দেয়,  সে আছে,  শীতঘুমে হলেও সে আছে...


No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত? ঋত্বিক ঘটক :   চলচ্চিত্র তৈরির প্রাথমিক লক্ষ্য মানবজাতির জন্য ভাল কিছু করা। যদি আপ...

পাঠকের পছন্দ