Monday, July 22, 2019

মান-অপমান, পঠন-পাঠন আর কিছু কিছু - অমর মিত্র






আসলে লেখা তো হয় অভিজ্ঞতা আর জীবনের  উপলব্ধি থেকে। আমার সেই প্রাক চল্লিশে বাঁকুড়ার নানা গঞ্জে বাস আমাকে সমৃদ্ধ করেছিল যে প্রকৃতি আর জনপদ আমাকে বিচিত্র জীবন দেখিয়েছিল, তা আমার সমস্ত জীবনের অর্জন হয়ে গেছে যেন। রক্তের ভিতরে প্রবেশ করেছে জীবন আর জীবন।  মনে পড়ে, ঠিক দুপুরে তিলুড়ি নামের এক গ্রামের ধারের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি বাসের জন্য। আছে দুই বুড়ি, শালতোড়া নামবে বলে বেরিয়ে এখানে এসে পড়েছে। কখন আবার বাস আসবে। আমিও বাসের জন্য বটের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছি। ছায়ার বাইরে ঘোর বৈশাখ। গরম হাওয়া।  দুই বুড়ি  ভিক্ষে করবে বলে বেরিয়েছে। উপায় নেই তা ছাড়া। আমি লিখতে বসে  ভেবে নিয়েছিলাম একজনের ঘাড়ে বিধবা ছেলের বউ, অন্য জনের ঘাড়ে বুড়ো অকেজো স্বামী। তাদের নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম সেইদিন সন্ধ্যায় ফিরে। দুই নারী। আমার প্রিয় গল্প। গল্প কীভাবে আসে তা ধরা যায় না। গল্পের জন্য, উপন্যাসের জন্য উপাদান জোগাড় করিনি কখনো, তা হয়েছে আপনা-আপনি, যাপিত জীবনই তার উপাদান দিয়ে দেয় মনের ভিতর। যা দেখিনি তা নিয়ে লেখা যায় আবার যায়ও না। কল্পনা লেখার এক মস্ত জায়গা। যা দেখিনি তা কল্পনায় দেখি। ম্যাকক্লাক্সিগঞ্জ যাইনি। শুনেছিলাম  অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বসতি করে গড়ে তোলা হয়েছিল সেই জনপদ। তা পরিত্যক্ত হয়েছে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার অবসান হতে। গল্প শুনেছিলাম এক বন্ধুর কাছে। পরে দেখলাম রমাপদ চৌধুরীর দরবারি গল্পটি ম্যাক্লাক্সিগঞ্জ নিয়ে। আমি একটি গল্প লিখেছিলাম ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ নামে। পরিত্যক্ত এক নগরের গল্প আমার কল্পনায় এসেছিল। আসলে যা দেখা, তা তো দেখাই,  যা না দেখা তা যেন আন্দাজ করে দেখা। আমি জানি লেখক এক অলীক ভুবন নির্মাণ করেন আন্দাজে আন্দাজে। এ যেন অন্ধকার নিষ্প্রদীপ পথে একা কোথাও যাওয়া। এই যাত্রাটি আমার ভাল লাগে। যা হয়তো হয়নি, হতে পারত, তা আন্দাজ করাও লেখা। আমি সেই চেষ্টা করতে করতে লিখেছি।
    লিখতে লিখতে আর অসামান্য শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বা মহাশ্বেতা, দেবেশ রায়ের সঙ্গ আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল মনের সেই জোর আর কলমে বিশ্বাস না থাকলে লেখা কঠিন। কবে আমাকে মহাসম্পাদক লিখতে বলবেন, আমি গালে হাত দিয়ে সেই চিঠির জন্য অপেক্ষা করব, তাহলে আমার লেখা হবে না, অপেক্ষা হবে। ফলে আমি লিখেছি, পান্ডুলিপি থেকে বই হয়েছে। ধ্রুবপুত্র, অশ্বচরিত সেই ভাবে বই।   প্রথম বই  ‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’ তো ব্যাঙ্ক থেকে ২০০০ টাকা ঋণ নিয়ে বের করেছিলাম।

  বড় কাগজে ফরমায়েসি উপন্যাস, ধারাবাহিক লিখতে পারিনি বলে আমার কোনো দুঃখ নেই । বরং না লিখে বেঁচে গেছি, আমি তাহলে ধ্রুবপুত্র, ধনপতির চর বা অশ্বচরিত, নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান লিখতে পারতাম না নিজের ভিতরের তাগিদ থেকে। মানুষের নিরুদ্দেশ যাত্রার পিছনে এই সমাজ, রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাকে আমি এড়াতে পারি না। আমার চারটি উপন্যাস এই বিষয়েই জড়িত। ধ্রুবপুত্র, অশ্বচরিত, নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান, সোনাই ছিল নদীর নাম। কবি, রাজপুত্রের অশ্ব, জুটমিল শ্রমিক এবং একটি নদীর নিরুদ্দেশ যাত্রা নিয়েই ওই চার উপন্যাস। আমার মনে হয় নিরুদ্দেশ যাত্রা শেষ হয়নি। ধনপতির চর উপন্যাসেও চর নিয়ে নিরুদ্দেশে যায় মৎস্যজীবীরা।
     সাহিত্য সাধনার জায়গা। আর গদ্য সাহিত্য এমন এক সাধনা যেখানে পরিশ্রম আর আরটের প্রতি নিজেকে সমর্পণ না থাকলে লেখা হয় না। আর থাকবে নিরূপায় আর দুঃখের জীবনকে চেনার চেষ্টা। লেখকের এক দায়বদ্ধতা আছেই, তা তাঁর যাপিত জীবন আর এই পৃথিবীর প্রতি। পৃথিবী শব্দটি অনেক বড় হতে পারে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় একটি উপন্যাস লিখেছিলেন ছোটদের, আসলে তা বড়দেরও,  ব্রহ্মান্ড কী প্রকান্ড---পৃথিবী ব্রহ্মান্ড সব একাকার হয়ে যায় আমার কল্পনায় নির্মাণ করা সেই ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ বা এই চেনা শহরটিকে অচেনা করে নিয়ে লিখতে বসার সময়। আমি আমার চারপাশ নিয়ে লিখতে স্বচ্ছন্দ। আমি যেমন দূর গোপীবল্লভপুরের গ্রাম, বনভূমি, হাঘরে চাষীদের কথা বুঝতে চেয়েছি সেখানে বাস করতে করতে, তেমনি আমার পাশের ফ্ল্যাটের সেই মেয়েটির কথাও লিখতে চেয়েছি যে কিনা এই শহর থেকে নিবার্সিত হয়েছিল নিষ্ঠুর পরিবারের লোভের বলি হয়ে। সে দূর উজ্জয়িনীতে গিয়ে বাড়ির সকলের জন্য, প্রতিবেশির মঙ্গল কামনায় মহাকাল মন্দিরে পুজো দিয়ে আসে। শিপ্রা নদীর ধারের মন্দিরে মন্দিরে যায় কলকাতা শহরে তার নিকটজনের মঙ্গলের জন্য। আসলে মানুষ দেখে দেখেই তো জীবন পার হয়ে যায়।  মানুষের নিরূপায়তা, দুঃখ, মানুষের ভিতরের লুকোন অশ্রু আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। আমি আন্তন চেখভের অনুরাগী। রুশ সাহিত্য পড়েছি অনেক। এখনো রুশ উপন্যাস, গল্প শ্রেষ্ঠ মনে হয়। ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট থেকে রেজারেকশন, আনা কারেনিনা, ক্রয়েটজার সোনাটা, ইভান ইলিচের মৃত্যু আমাকে এখনো মুগ্ধ করে রেখেছে। মুগ্ধ করে রেখেছে আরো কত লেখা। যখন লেখা আসতে চায় না। বসেই থাকি, বসেই থাকি, তখন পড়তে হয়। কী পড়ব তা আমি নিজেই টের পাই। ভাল লেখা উদবুদ্ধ করে। এখন হারুকি মুরাকামি মুগ্ধ করেছেন। কাফকা অন শোর এবং  আর একটি উপন্যাস সম্প্রতি পড়েছি।
    
সমুদ্রতীরে কাফকা পড়েছি  অপূর্ব অনুবাদে।  পড়ে বিমোহিত। ৮০০ পাতা পড়ে জীবনের কত আলো ছায়া যে প্রত্যক্ষ করলাম। নমস্য লেখক। সঙ্গীতের নানা ঢেউ-রেখায় তাঁর উপন্যাস যেন অলঙ্কৃত। কাফকা তাঁর বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে লিখে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর সব লেখা যেন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এই উপন্যাসের সাএকি-সান যে আত্মজীবনী লেখেন, বা নিজের সেই ব্যর্থ প্রেমের কথা লেখেন, সেই পাণ্ডুলিপি মৃত্যুর আগে পুড়িয়ে দিতে বলেন। তা করা হয়। শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে ভ্রাম্যমান নাকাতা সান খুঁজছিল স্মৃতির  প্রবেশ পথ দিয়ে কোথাও একটি পৌঁছতে। পৌঁছেছিল সাএকি-সান এর কাছে। সেই পাণ্ডুলিপি  সে ধ্বংস করে। যে বনের ভিতরে যে প্রবেশ পথ দিয়ে এক নিঝুম জনপদে প্রবেশ করেছিল কিশোর তামুরা কুন, যেখানে পৌছেছিল, আমি বহুদিন আগে পড়া রে ব্রাডবেরির এক গল্পের ছায়া পাই। সঙ্গীত এবং সায়েন্স ফিকশন দুইই তাঁর জীবনের দর্শন নির্মাণ করেছে যেন। সায়েন্স ফিকশনে যে সময় থেকে সময়ান্তরে পরিভ্রমণ, তা মুরাকামির লেখায় যেন ছায়া রেখেছে। বহুদিন আগে অশ্বচরিতের ঘোড়াটি  ১৯৯৭-এর বুদ্ধ পূর্ণিমার রাত থেকে ১৯৪৫-এর হিরোসিমার কালো বৃষ্টির ভিতরে ছুটে গিয়েছিল। সেই অশ্বই আবার রাজপুত্র গৌতমকে কপিলাবস্তু থেকে তপোবনে পৌছেছিল। রাজপুত্র গৃহত্যাগ করলেন। সময় থেকে সময়ান্তরে ভ্রমণ আমার পছন্দের। তা ধনপতির চর উপন্যাসে আছে। সদ্য সমাপ্ত মোমেনশাহি উপাখ্যানে আছে। তিনশো বছর ধরে বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী হতে দুই বন্ধু আসে আর দেখা শেষ হলে নিরুদ্দেশে চলে যায়।
   
    হ্যাঁ, যা বলছিলাম, মুরাকামির  এই উপন্যাস পাঠ এই নশ্বর জীবনের এক বড় অভিজ্ঞতা। অনেক বলার আছে। সবই অনুভবের কথা। তবে লিখতে হলে পড়তে হবে, আর সঙ্গীতের কাছে নতজানু হতে হবে। আমরা তো জানি এই গাছ-পালা, বন বনানী, নদীর ছল ছল, বাতাস, মেঘের ডাক, পাখির কুজন......সবই সঙ্গীতের সূত্র। সঙ্গীতের কাছে যাওয়া মানে এই মহাপৃথিবীর সামনে প্রণত হওয়া। মুরাকামি সঙ্গীতের কাছে  প্রণত যে তা তাঁর সব লেখায় পাওয়া যায়।   

   মহৎ সাহিত্য পাঠ ভাল লিখতে সাহায্য করে। বাঁকুড়া থেকে চলে আসি চার বছর কাটিয়ে। তারপর থেকে কলকাতার আশপাশে, গ্রাম গঞ্জে ঘুরেছি কম নয়। সেই দেখা বাঁকুড়া যাওয়ার আগেও হয়েছিল। আমার কাছে সম্পাদকের গল্প তেমন নেই, যেমন আছে অগ্রজ আর অনুজ লেখকদের গল্প।
    
     আমি যাঁদের সঙ্গে মিশেছি, যাঁদের কাছে সাহিত্যের কথা শুনেছি, সেই বিমল কর, শ্যামল, অতীন, মহাশ্বেতা, দেবেশ রায়, দিব্যেন্দু পালিত তাঁদের লেখার গুনেই আমার প্রিয়। আমি সত্যযুগ, বারোমাস কিংবা অনীক  পত্রিকায়  উপন্যাস লিখেছি। তখন আমার বন্ধু লিখছেন নামী বড় প্রতিষ্ঠানের দামী পত্রিকায়। আমার লেখা দশজন পড়লে তাঁদের লেখা হাজারজন পড়েছেন।  তাতে আমার কোনো দুঃখ হয়নি। হতাশা ছিল না। হতাশা থাকলে লিখতে পারতাম না। প্রকাশ্য সভায় আগ বাড়িয়ে আমার সমকালীন  বড় প্রতিষ্ঠানে লালিত নামী লেখক ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ধ্রুবচরিত লেখকের লেখা পড়ব না। মঞ্চে ছিলেন যাঁরা, তাঁরা আমাকে ফোনে জানিয়েছেন, আপনার সঙ্গে কি ওঁর গোলমাল হয়েছে ?  আমি অবাক, আগের দিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, কথা বলেছি। দুঃখ হয়নি। মনে হয়েছে এই আমার প্রাপ্য। দূর মফস্বল থেকে কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তিনি। রাত হয়ে যাওয়ায় আমার বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। সাধ্যমতো যত্ন করেছিলাম। আমি  কোনোদিন তাঁর লেখার নিন্দা করিনি। এখনো মনে করি খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখক। তাঁর কিছু  লেখাতো  আমার প্রিয়। নিন্দা করতে  রুচিতে বেঁধেছে।  বরং তাঁকে চরিত্র করে এক ঔপন্যাসিক  নোংরা লেখা কেউ লিখলে, আমি সম্পাদককে  ফোনে  বলেছি অন্যায় কাজ এটি। যিনি লিখেছেন তিনি রুচি গর্হিত কাজ করেছেন। এই অভিজ্ঞতা আরো হয়েছে। এগুলি এখন তুচ্ছ মনে হয়। জীবনের অংশ। সেই লেখকের সঙ্গে দেখা হলে আমি তো কথা বলি। নিজের কলমের উপর বিশ্বাস, নিজের গভীর আত্মবিশ্বাস থাকলে এসবে কিছু যায় আসে না।  বড় সম্মান পাওয়ার পর অনেক  তরুণ বন্ধু-লেখক আমার ছায়া মাড়াতেন না। কারণ  তিনি  রাগ করবেন। তিনি অখুশি হয়েছিলেন আমার সেই অর্জনে। তিনিই যেন শেষ কথা। ক্ষমতা চলে গেলে তিনি আর তিনি থাকেন না।  এখন সেই তরুণরা ফিরে এসেছেন, আমার মনের দাগ মিলিয়ে গেছে। কিন্তু আমার বই তের বছরে মাত্র দুটি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।       
     গত শতকের ৯০-এর দশকে একটি  উপন্যাস নিয়ে একটি সংখ্যা করা হয়েছিল এক অভিসন্ধিমূলক   প্ররোচনায়, আমি ছিলাম ভারবাহী সম্পাদক।  তারপর সেই বই অনেক সম্মান পায়, কারো পদোন্নতি হয়,  সে এক আশ্চর্য উপাখ্যান।  আমি ব্যাগে পত্রিকা নিয়ে বাড়ি ফিরেছি, বিতরণ করেছি, বাংলা একাডেমি সভাঘরে সেই বই নিয়ে অনুষ্ঠান করেছি, পরে তিনি আমার সম্পর্কে খারাপ কথা  না বলে, জল খেতেন না বোধ হয়। তরুণ দুই লেখক ভিন্ন ভিন্ন সময়ে  আমাকে এসে বলেছেন, অমুকে বই মেলায় তাদের ডেকে বলল,  “ঐ বাঞ্চোতটির সঙ্গে মিশিস কেন’ ? হ্যাঁ, বাঞ্চোত আমাদের সহযাত্রী আর এক লেখকও হয়েছিলেন। আমরা দুজন। কারণ আমাদের লেখালেখি। এসব কাহিনির শেষ নেই। আর এসব কাহিনির পাশে ভালো কথাও আছে এই জীবনে অনেক। হ্যাঁ, আছে, আছে,  আছে। ভদ্রেশ্বর ইস্কুলের হেড মিস্ট্রেস গৌরী বিশ্বাস  আমার মাথায় ফুল ছড়িয়ে ছিলেন তাঁর আমন্ত্রণে শ্রীরামপুরে তাঁর বাড়িতে গেলে।  
     
  
      আরম্ভে কেন এখনো আমি খাঁটি সাহিত্য পত্রের নিয়মিত লেখক। তার ভিতরে ছিল বারোমাস, পরিচয়, অনীক।  এখন শুধুই অনুষ্টুপ। গল্প লেখা কমে গেছে। হ্যাঁ,  এর সঙ্গে আছে কিছু বাণিজ্যিক পত্রিকা। বর্তমান, আজকাল, প্রতিদিন সংবাদপত্রে আমি লিখি। যিনি সমাদর করে লিখতে বলেন , আমি লিখি। আমি একই সঙ্গে শারদীয় অনীক ও বর্তমান, আনন্দবাজারে লিখেছি। আমার কোনো অসুবিধে হয় নি। শারদীয় ‘এই সময়’ পত্রিকায়  গল্প পড়ে  সম্পূর্ণ বামপন্থায় বিশ্বাসী অনীক সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তী  আমাকে ফোনে বলেছিলেন, গল্পটি তুমি অনীকে দিতে পারতে। অনীকের গল্প এইটি। আবার অনীকে লিখেছিলাম প্রাণবায়ু নামের যে গল্প, সেই গল্প পড়ে অনীকের পাঠকদের একটা অংশ খুব নিন্দা করেছিলেন যৌনতার ব্যবহারে। কেউ কেউ বলেছিলেন, আনন্দবাজারের গল্প ঐটি। কিন্তু আনন্দবাজার শারদীয়তে ‘ কোকিল’ লিখেছিলাম। পৌন্ড্র ক্ষত্রিয় এক নাচার যুবক অফিসে পিয়নের চাকরি পেয়ে বুঝেছে, অফিসের উচ্চ বর্ণের বাবুদের সেবা করাই সরকারি চাকুরি। দেশ পত্রিকার শেষ গল্প স্বদেশযাত্রা, বিহারের বাথানিয়াটোলায় হরিজন, দলিত হত্যা সেই গল্পের বিষয়। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।  আমি এখনো বলতে পারি আমি যে লেখা লিখতে পারি সেই লেখাই লিখতে চেষ্টা করি, কাগজ হিসেব করে লিখি না।  এক তরুণ লেখক বন্ধু, জয়ন্ত দে আমাকে বলেছিলেন, জীবনে বহুদিকেই সমঝোতা করতে হয়, কিন্তু সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি চেষ্টা করবেন তা না করতে। তিনি খুব ভালো  লেখক।  খুব ভালো লেগেছিল সেই কথা। তরুণ লেখকদের সঙ্গে মিশতে ভা্লো  লাগে। তাঁরা কী ভাবছেন তা বোঝার চেষ্টা করি। তাঁদের জীবনের উত্তাপে তাপিত হই।  

 লেখক যিনি তাঁকে জীবনের অনেক ঘাত প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। কুসুমাস্তীর্ণ পথ লেখকের নয়। অনেক প্রত্যাখ্যান, অনেক অপমান তাঁর সমস্ত জীবনের স্মৃতি। অনেক ভালোবাসা আর সম্মানও। গ্রহণ বর্জনেই জীবন পূর্ণ হয় যেমন হয়, গল্প আর উপন্যাস। মান-অপমানই তাঁকে আবার লেখার পথে ফেরায়, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে তোলে। যত বয়স হয়, লেখক নির্বান্ধব হন যদি না তিনি কোনো না কোনো ক্ষমতার অধিকারী হন। ক্ষমতার বন্ধু বন্ধু নন। ক্ষমতা চলে গেলে তাঁরা সরে যান। এসব এত বছরের অভিজ্ঞতা। জীবনের ভালো মন্দ থাকে। ভালোটুকু গ্রহণ করে, মন্দকে ভুলে গেলেই ভালো। নাহলে মন্দ- চর্চা তাঁর লেখাতেও থাবা মারে। কিন্তু লেখার ভিতরে তাঁর জীবনের ঘ্রাণই তো থাকে, তার ভিতরে আলো, তার ভিতরে অন্ধকার। একেবারে এড়িয়ে যেতে পারি না। এই উপাখ্যানে  যা হয়েছে তাই লিখেছি। যা হয়নি তা লিখিনি। কাউকে অসম্মান করতে চাই না।  লেখক যেন স্বধর্মেই স্থিত থাকতে পারেন। হে মহাজীবন, আমি  তোমার কাছে প্রণত।            
            

8 comments:

  1. প্রণত এই লেখার কাছে। অনেককিছু শিখলাম। প্রাণিত হলাম। শ্রদ্ধা জানাই অমরদা।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো লেখাটা।সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
  3. লেখকজীবনের সার কথা। সেই লেখক ভাগ্যবান যার তরুণ বন্ধু আছে, যেমন আপনি। ভালো থাকুন, অমরদা।

    ReplyDelete
  4. অসাধারণ হয়েছে লেখাটা।আমি লেখাটা পড়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবছিলাম, এত সহজে আপনি কী সুন্দর বলেন। প্রণাম।

    ReplyDelete
  5. একবারের তরেও মনোযোগ ছিন্ন হলো না । এক নিঃশ্বাসে পড়লাম । কত যে মিল পেলাম ! যখনই চারিপাশে নানা কারণে বিদ্ধ হই আমিও সাহিত্যে মুখ গুঁজে থাকি । অবশ্যই কালোত্তীর্ণ সাহিত্যে । আবার বাঁচার প্রেরণা পাই । এমন আত্মকথা প্রেরণা দেয় ।

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত? ঋত্বিক ঘটক :   চলচ্চিত্র তৈরির প্রাথমিক লক্ষ্য মানবজাতির জন্য ভাল কিছু করা। যদি আপ...

পাঠকের পছন্দ