পার্থজিৎ চন্দ-- নিজেকে নিজেই স্বাধীনতা দিইনি; আমি আর কার কাছে স্বাধীনতা চাইব?








বেশ কয়েক মাস আগের ঘটনা সাধারণত আজকাল খবরের কাগজ খুলে আর চোখ আটকে যাবার ঘটনা ঘটে না। সেই ছকে বাঁধা খুন-জখম, হত্যালীলা, জমিদখল, প্রোমোটাররাজ, হুমকি আর দলবদলের চেনা খবরগুলিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ে নিই রোজ পড়তে পড়তে ধূসর সিল্যুয়েটের মতো মনে পড়ে যায় ‘সিটিজেন কেন’ সিনেমায় মিডিয়া-ব্যারনের সেই উচ্চারণ, হেডলাইন বড় হলে খবরকে বাড়িয়ে তোলো হেডলাইনের মাপে। মানুষের ঘামের গন্ধ চেনে না এমন নেতার পাতাজোড়া সাক্ষাৎকার পড়বার ধকল নেওয়া চোখ অনেক দিন পর একটু থমকে গিয়েছিল।
            বেশ কয়েকটি ডিম আঁকড়ে, কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রয়েছে বিষধর মা-সাপ। পুরানো বাড়ি ভাঙতে গিয়ে বারবার মানুষ শুনতে পাচ্ছে সেই সাপের ফোঁস-ফোঁস আওয়াজ। কিছুতেই নড়ানো যাচ্ছে না তাকে। খবরের কাগজের ভাষায় এই সত্যিটাও ‘বিগ স্টোরি’। শেষ হয়েছিল অদ্ভুতভাবে; অনেকের চোখে জল চলে আসছে মা-সাপের এই স্নেহ দেখে। না-জন্মানো বাচ্চার জন্য এই স্নেহ ভিতরে ভিতরে দূর্বল করে দিচ্ছে তাদের।
            সম্ভবত খুব বড় কোনও স্মৃতির দাগকে আমরা তক্ষুনি চিনতে পারি না। ‘স্পট’ করতে পারি না। দিনের পর দিন সেটা চেপে বসে মনের মধ্যে। তারপর একদিন হিমশৈলের চূড়ার মতো মাথা তুলে দেখা দেয় আমাদের।
            এটিও তেমন। যখন পড়েছিলাম তখন একরকম। কিন্তু দিনের পর দিন একটা অস্বস্তি কাজ করতে শুরু করেছে।
            ছোটবেলা থেকে আমরা তো এটা শুনেই অভ্যস্ত, সাপ সাপের বাচ্চা খায়। নিশ্চয় সব বাচ্চাকে খায় না। সেটা হলে পৃথিবীতে অঙ্কের নিয়মেই একটিও সাপ বেঁচে থাকার কথা নয়।
            কিন্তু এই খবরটা! এই মা-সাপের না-ফোটা ডিম বেড় দিয়ে ঘিরে থাকা, না-জন্মানো সন্তানের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া মায়ের ওম ... এটিও সত্য। অবধারিত ভাবে সত্য। সাপের মধ্যেও নিশ্চয় সন্তানের প্রতি স্নেহ বেঁচে থাকে। না-থাকলে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বাচ্চাসাপের বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না।
            এবার সাপ ও সাপের ডিমের এই ধাঁধার থেকে একটু বেরিয়ে আসা যাক।
রাষ্ট্র মূলত ঐ মা-সাপের মতোই। সে তার বাচ্চাকে খেয়ে বেঁচে থাকে অনেক সময়ে। আবার মা-সাপের ওমটুকুও দেয়। অনিবার্যভাবেই দেয়। না-দিলে এতদিনে রাষ্ট্র ব্যবস্থাটাই উঠে যেত।
            রাষ্ট্র তোমাকে প্রতিদিন পরাধীন করবে। প্রতিদিন মাথা নীচু করে বেঁচে থাকতে শেখাবে। প্রতিদিন কাঁকরের থেকে চাল বেছে উনুনে চাপাবার পর দেখবে দূরে হুটার বাজিয়ে চলে যাচ্ছে কার যেন দুধ-সাদা গাড়ি। কনভয়।
            এসব ঘটার পরেও রাষ্ট্র তোমাকে এক ধরণের ‘সুরক্ষা’ দেবার প্রতিশ্রুতি দেবে। মা ও মাতৃভূমি অভিন্ন হয়ে উঠবে তোমার কাছে। ক্রমাগত সেই ধারণার মধ্যে বাঁচতে বাঁচতে মায়ের মুখের মতো হয়ে উঠবে তোমার দেশের ম্যাপ।
            মাঝে মাঝে বুক হুহু করে উঠবে তোমার। যে দেশে জন্মেছ সে-দেশের প্রতিটি ধূলিকণার মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করবে। কান্না পাবে। মনে হবে, এই দেশটুকু তোমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে। যদিও পরের দিন সকালে স্বাধীনতার ‘বানান’ তোমাকে জিজ্ঞেস করলে তুমি থম মেরে থাকবে।
            ঠিক এখানে এসে এটা বলাও প্রায় অসম্ভব, ‘এই স্বাধীনতা আমি চাই না।’
            সেই তো কবেই আওয়াজ উঠেছিল ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়।’ তারপর নর্মদা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। রাষ্ট্রের ভেতর অনেক আলো অন্ধকার। আজ সেই স্লোগানকেও মনে হয়, রাগী যুবকের হুঙ্কার। অনেকটা ‘মাদার ইন্ডিয়া’র সেই ছেলেটির মতো। যার মায়ের জন্য একবুক ভালোবাসা। কিন্তু এক পারাপারহীন ক্রোধ তাকে মাঝে মাঝে অন্ধ করে দেয়।
            এই যে ধারণা, যে ধারণা থেকে আমি এই ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’র ক্রমশ বদলে যাওয়া ‘ইন্টারপ্রিটেশন’টিকে তুলে ধরলাম, এটিকে তৈরী করল কে? রাষ্ট্রই তৈরী করেছে। এবং বিশ্বাস করুন, দশকের পর দশক ধরে ক্রমশ পরিবর্তিত হতে হতে এই ধারণাটিই আজ সব থেকে গ্রহণযোগ্য হয়ে ঢুকে গেছে মানুষের মনে।
            বিপ্লবীকে নির্দিষ্ট একটা ‘ইমেজে’ গেঁথে ফেলতে রাষ্ট্রের মতো দক্ষ কেউ নেই। তাকে ননির পুতুলের মতো নানা শেপ দেওয়া হয় ক্রমাগত। একদিন ঘোষণা করা হয়, তিনি খুব ‘রোম্যান্টিক’ ছিলেন। প্রথমে বলা হয় তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা চাই। না দিলে বিপ্লব হোক... রোটি কাপড়া আউর মকানের ব্যবস্থা হোক।’
            তারপর সেই জিভের তলায় লজেন্স রেখে বলিয়ে নেওয়া হয়, ‘স্বাধীনতা চাই না। বিপ্লব চাই না। শুধু রোটির ব্যবস্থা হোক। আমরা ল্যাংটো হয়ে খোলা আকাশের নীচেও বাঁচতে পারি...।’
তাঁর রোম্যান্টিক ধারণাটি এতক্ষণে পূর্ণ হয়ে ওঠে।


কিন্তু এই ২০১৯ সালে দাঁড়িয়ে আমাদের অবস্থা তো আরও জটিল। কোন স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে চিৎকার করে উঠব আমরা?
            আমরা তো সেই প্রজন্মের; যাদের এমনকি ‘স্বাধীনতা’কে (বারবার ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি লিখলেও সেটি যে আসলে চূড়ান্ত পরাধীনতার সমাহার সেটি নিশ্চয় পাঠক বুঝতে পারছেন) অস্বীকার করে চিৎকার করে ওঠবারও সুযোগ নেই।
            যে আপনি এই লেখাটি পড়ছেন তিনি একই সঙ্গে আমার মতোই বেশ কয়েকটি ‘স্টেটের’ বাসিন্দা। সেই সব স্টেট ... যার কারও মাথায় বসে জুকেরবার্গ কারও মাথায় ট্রাম্প; আবার কারও মাথার ওপর কে বসে আছেন সেই মুখটিকে আপনি দেখতেও পাবেন না।
            কিন্তু আপনি এতদিনে ভালোবেসে ফেলেছেন ডোনাল্ড ট্রাপ’কে। যদিও জানেন না তার সঙ্গে ছায়ার মতো জড়িয়ে রয়েছে ছ’বার (৬ বার, হ্যাঁ ঠিক পড়েছেন) ‘ব্যাংকর‌্যাপসির’ ইতিহাস।
            বিজয় মাল্যর মাসতুতো ভাই হতেই পারতেন ট্রাম্প।
            তার আমেরিকা আজ আপনাকে সাহস দিচ্ছে আপনার ঘোষিত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়বার। (যদিও নিশ্চিত থাকুন, আপনার শত্রুকেও সেই অস্ত্র বিক্রি করে)। ফলে ট্রাম্পের দক্ষিণপন্থা আপনাকে স্বাধীনতার নামে যে স্পেস প্রদান করছে এবং মানসিক স্তরে যে ক্ষমতা প্রদান করছে তার থেকে আপনি বেরিয়ে আসতে পারবেন না সহজে।
            কল্পরাষ্ট্র যে ভার্চুয়াল দুনিয়া, সেখানে প্রতিদিন আপনাকে দেউলিয়া করে চলেছে আপনার ‘রাষ্ট্র’। সেখানে যে dicatatorship of data চলেছে প্রতিদিন তাকে আপনি দেখতে পান না। এক বোবা-জন্তুর মতো তার কাছে ফিরে ফিরে আসেন।
            আসলে স্বাধীনতা ও পরাধীনতা নিয়ে আমরা যত বেশী ‘মানসিক স্তরে’ চর্চা করেছি ‘বাস্তবে’ ততটা করিনি। মনে রাখতে ভুলে গেছি, ব্যক্তি মানুষের মানসিক স্তরে যে অ্যনার্কিজম সে নিয়ে এই সময়ে রাষ্ট্র আর বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়। বরং সে সেটিকে লালন করতে উৎসাহ দেয়। অনেকটা প্রেসার কুকারের সেফটি-ভালভের মতো। খুলে গেলে স্বস্তি। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের – উভয়েরই।
            বাস্তবে যে প্রতিরোধ প্রয়োজন ছিল সেটিকে আমরা সকলেই যত্নে এড়িয়ে গেছি। এক অন্ধকার জগতের বোবা রাজা হয়ে বেঁচে থাকতে শিখে গেছি। আমার বিশ্বাস দিন দিন দৃঢ় হচ্ছে … একদিন সম্পূর্ণ বোবা হয়ে যাবে মানুষ। তার গলার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘অ্যাডাম’স আপেল’টি লুপ্তপ্রায় অঙ্গে পরিণত হবে।

            চিৎকার নয়; এই নিস্তবদ্ধতার স্বাধীনতাই বোধহয় চেয়ে চলেছি আমরা। 

1 comment:

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত? ঋত্বিক ঘটক :   চলচ্চিত্র তৈরির প্রাথমিক লক্ষ্য মানবজাতির জন্য ভাল কিছু করা। যদি আপ...

পাঠকের পছন্দ