সম্প্রতি
জানলাম, সৎকার শব্দটির আসল অর্থ এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে পচে না গিয়ে আত্মা বেরিয়ে
আসে। এই অর্থ একটা দরজা খুলে দিল। আর মনে হল যে, স্বাধীনতারও সৎকার প্রয়োজন। কারণ
কিছু বিধিবদ্ধ ধারণার পচন এর আত্মাটিকে আচ্ছন্ন করে তুলেছে। সবথেকে আগে তাই
স্বাধীনতা দরকার স্বাধীনতারই।
কিন্তু
স্বাধীনতা, তার মুক্তি কার কাছে চাইবে? স্বাধীনতা কি নিজের কাছেই স্বাধীনতা চাইতে
পারে! নাকি, যারা তাকে ব্যবহার করে, অর্থাৎ আমরা, আমাদের থেকে তাকে চেয়ে বা আদায়
করে নিতে হবে স্বাধীনতা? বা আত্মার মুক্তি! এই ধন্দের সামসামনি প্রায়ই হয়ে পড়ি,
যখন দেখি কোনও ছাত্রনেতা তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বলছেন, ‘ভুখমারিসে আজাদি’। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার প্রতিবাদকারী যুবও
দেখলাম একই কথা বলছেন। নিশ্চিত এই আজাদি বিদ্যাসাগরের থেকে তাঁরা চাইছেন না। তাহলে
কার থেকে? রাষ্ট্রের থেকে? তার থেকেও বড়ো কথা, তাঁরা কি আদৌ চাইছেন? নাকি ঘোষণা
করছেন! কিন্তু যা ঘোষিত হয়, হয় তা ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। নয় ভবিষ্যতে সম্পন্ন
হবে। আমাদের দেশে অনাহারের পরিসংখ্যান, এই সত্তর বছর পরেও, নিশ্চয়তা দেয় না যে,
‘ভুখমারিসে আজাদি’ আশু সম্পন্ন হবে। বরং এ একটা প্রকল্প যা জিইয়েই রাখা হয়েছে। এবং
তা যতদিন জিইয়ে থাকবে, ততদিন সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে বেঁচে থাকা গণতন্ত্র
কোনক্রমে গা বাঁচিয়ে ভেসে থাকবে। ফলত, স্বাধীন দেশের এ নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই।
কারণ, যে স্বাধীনতার ধারণা স্বাধীন দেশ লালন করে চলেছে, সেখানে অনাহার থেকে
মুক্তির কোনও জায়গা নেই। অর্থাৎ, পেটের
ভাতের নিরিখে স্বাধীন দেশ নিজেই নিজেকে পরাধীন, পদানত করে রাখতে ভালোবাসে। তাহলে
আমরা যে স্বাধীনতা উদযাপন করি সে কাদের কথা? মিডনাইটস চিলড্রেন-এর সেই লোকটিকে মনে
পড়ে। যে উদভ্রান্তের মতো হাসপাতালে ঢুকে বলেছিল, এ স্বাধীনতা স্বাধীনতাই নয়। কারণ
এ কেবল ধনীদের স্বাধীনতা। প্রকৃত স্বাধীনতা একজন গরিবকে ধনী হওয়ার পরিসর দিত। সেই
বক্তব্যের জেরেই সেদিন নার্স দুই শিশুর নিয়তিলেখাই বদলে দিয়েছিলেন। সে কাহিনি
আমাদের জানা। কিন্তু কথা হল, এই যে একজন
যুব তাঁর দৃপ্ত স্লোগানে আজাদি চাইলেন অনাহার থেকে, সে যদি রাষ্ট্রের কাছেই হয়,
তবে তো তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। ইতিহাস বলছে, সরাসরি সংগ্রামের পথও তেমন মসৃণ নয়,
পরিণাম সবদিক থেকেই ভয়াবহ। অথচ একটা আপাত কিংবা ছদ্ম-গণতান্ত্রিক দেশে এই স্লোগান
তোলা বা দাবি জানানো বা প্রার্থনা জানানো ছাড়া একজন দলীয় ছেলে আর কীই-বা করতে
পারে। তকেও তো গণতান্ত্রিক মতেই আন্দোলন করতে হবে। সেই গণতন্ত্র, যা কি না
শাসকশ্রেণি তাঁদের সুবিধামতো রক্ষাকবচের স্টাইলে ডিজাইন বা কাস্টোমাইজ করে রেখেছে।
তাহলে কি বলব, এই আজাদির ইচ্ছেটুকুও অন্তত যে পথে হাঁটছে, সে আসলে স্বাধীন পথ নয়!
অথচ, বিকল্প রাস্তা ধরতে গেলে যে পথ মাড়াতে হবে, তা দলীয়তার উপরে উঠে। সেই
স্বাধীনতা কি লভ্য? আমাদের প্রচলিত স্বাধীনতার ধারণা তাকে অনুমোদন দিতে কি দু-বার
ভাববে না!
দলীয়তা
পেরিয়ে যে স্বাধীনতার অনুশীলন, তা বারেবারেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। শুধু দল কেন,
ব্যক্তিকেও যদি একটা সংগঠন হিসেবে ধরি, তবে ব্যক্তিভেদেও এই স্বাধীনতার পরিসর থাকা
উচিত। কিন্তু আমরা দিই না। অথচ গণতান্ত্রিক বলে এখনও কিছু গর্ব অবশিষ্ট আছে।
ব্যক্তি স্বাধীনতা বা মতপার্থক্যের স্বাধীনতাকে যথাক্রমে স্বেচ্ছাচার আর
পক্ষাবলম্বনের জোয়ালে জুতে দেওয়ার ফলে বেশ গোলমেলে পরিস্থিতিরই যে জন্ম হয়, তা
আমরা জানি। একদা কমিউনিস্ট পার্টির তরুণ
সদস্য ঋত্বিক কুমার ঘটক স্টুডিও চত্বরে মদ্যপান না-করার ব্যাপারে একটা
অ্যাসোসিয়েশনই খুলে ফেলেছিলেন। মদ্যপান নিয়ে চারু মজুমদারকেও নাকি নানা সমালোচনার
মুখে পড়তে হত। এবং তিনি প্রত্যুত্তরে স্বয়ং মার্কসের মদ্যপানের কথা বলতাম। এখানে
প্রসঙ্গ মদ্যপানের স্বাধীনতা অবশ্যই নয়। কিন্তু কথা হল, ঋত্বিকের গোঁড়ামিতে সেদিন আমল
দেননি স্বয়ং প্রমথেশ বড়ুয়া। আবার, চারুবাবু যখন বিপ্লবের অন্য পথে ঝুঁকলেন, তখন
তাঁর স্ত্রী কিন্তু সেই পথ অনুসরণ করেননি। সাম্প্রতিক অনুষ্টুপ পত্রিকায়
অশ্রুকুমার সিকদারকে নিয়ে যে ক্রোড়পত্রটি হয়েছে সেখানে ‘আমার শহরের কয়েকজন
কমিউনিস্ট’ প্রবন্ধটি আছে। তা থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি, ‘নকশাল নেতা চারু
মজুমদার স্কুল-কলেজ ভেঙে ছাত্রদের বেরিয়ে আসতে বলেছেন, বলেছেন এই পড়াশুনো চলবে না।
কিন্তু তাঁর তিন সন্তান তো সে নির্দেশ মানেনি, উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছে। এজন্য তাদের
সমালোচনা শুনতে হয়। কিন্তু তারা তো লীলাদিরও সন্তান। লীলাদি চারুদার শিক্ষা
সংক্রান্ত মতের সমর্থক না-ও হতে পারেন।’ এই ‘না-ও হতে পারা’টা জরুরি। এটাই বলার
প্রয়োজনে এই উদ্ধৃতি। আমরা যেমন জানি, ‘সুবর্ণরেখা’কে বুর্জোয়া সিনেমা ভেবে
ঋত্বিকের কমিউনিস্ট বন্ধুবান্ধবদের বেশিরভাগই প্রায় তাঁকে একঘরে করেছিলেন।
ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন, সে ইতিহাস রক্ষিতও আছে। কিন্তু প্রায় তখনই সিপিআই নেতা পি
সি জোশি ঋত্বিকের প্রশংসা করেছিলেন। সুবর্ণরেখাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। ঋত্বিক পরে
সুরমা ঘটককে লেখা চিঠিতে সে কথা জানান। স্বাধীনতা প্রসঙ্গে এই অসংলগ্ন খণ্ডিত
অংশগুলোর আমদানি এই কারণেই যে, আসলে আমি বলতে চাইছি, কাঠামোর ভিতরেও কোথাও একটা
প্রাণ থাকা দরকার। যাতে আলো-হাওয়া খেলে। এবং তবেই দলীয়তা নিরপেক্ষ কিছু স্বাধীনতা
অনুশীলন সম্ভব। এমনকী ব্যক্তিস্তরেও।
এখন, উপনিষদের শ্রেয় তত্ত্ব যে প্রসারিত মানবতার কথা বলে সার্ত্রেও হরেদরে
তাই-ই বলছেন। ব্যক্তিকে বস্তু হিসেবে ধরে নিলে মুশকিল। মানুষকে গড় এবং গড়পড়তা ধরে
নিয়ে যে আন্দোলন বা আদর্শই চলুক না কেন, তা ঘুরিয়ে ব্যক্তিকেই অপমান করে। ফলে রবীন্দ্রনাথের অন্তুও হাঁপিয়ে ওঠে। আজ, আমরা
বুঝি সেই হাঁপিয়ে ওঠা কেবল ব্যক্তির হাঁসফাসও নয়। বরং দমবন্ধকরা যে ফাঁস সেদিন
মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, আজ তাতেই নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। ব্যক্তিকে পরিসর
দিতে যে যতখানি নারাজ হয়েছে, ব্যক্তির ভার তার উপরে ততখানি এসে পড়েছে। এবং
কালক্রমে সমস্ত দুর্গের পতনের সাক্ষী হয়েছি আমরা। অবশ্য, এই ব্যক্তিকে স্বাধীনতা
দেওয়ার প্রসঙ্গ আমাদের উপনিষদও যে দায়িত্ববোধ তুলে দিচ্ছে হাতে, সার্ত্রেও তাই
করেন। এবং সেই দায়িত্বের অনুধাবন প্রসারিত মানবতার ভূমিতেই। সুতরাং, এই দায়িত্ব
দলীয়তা মেনে নিতে পারে না। বরং কাঠামোর
বাইরে থেকেই সে কিছু করতে চায়। পারেও। ২০১৭ সালে সমর সেন স্মারক যে বক্তৃতা
দিয়েছিলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, সেটির প্রকাশিত লিখিত রূপে পাই, একজায়গায়
তিনি বলছেন, ‘আমি বলি, এক একটা ভালো ছাত্রকে বই আর টাকা দিয়ে কী হবে, যখন আমি
অত্যন্ত বিশ্বস্তসূত্রে জানি নতুন-নতুন পাঠ্য বইগুলি নিম্নবর্গের ছাত্র, যারা বড়ো
হয়ে সম্ভাব্য ভোটার হবে, তাদের জন্য লেখা হয় না। আমি সাহায্য করতে চেয়েছিলাম,
বইগুলো বদলানোর কথা বলেছিলাম, যাতে নীচুতলার সঙ্গে সম্পর্ক থাকে। কিন্তু অনুরোধ
অগ্রাহ্য হল। কত লোক ইসকুল করে, ইসকুল আড়ি বানায়। আমি বলছ শিক্ষাপ্রণালী বদলানোর
কথা।’ এ তো সেই গোড়ার কথা, যা আমাদের স্বাধীনতারই চাওয়া উচিত ছিল। ঋত্বিক যখন
ওঁরাও শ্রেণির নাচকে অনেকক্ষণ ধরে সংযুক্ত করেন ছবিতে, আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে,
এতক্ষণ কেন? কিন্তু বস্তুত তা অবশ্যম্ভাবী। এ প্রশ্ন না জাগলে তো ইতিহাসের সংযুক্তিকরণ
সম্ভব নয়। যেমন ইনি বলছেন, বইগুলোকে জাতীয়তাবাদ ঠাসা না করে, এমনভাবে প্রণয়ন করা
যাতে নীচুতলার সঙ্গে সম্পর্ক থাকে। কিন্তু তা অগ্রাহ্য হয় কারণেই যে আমাদের স্বাধীনতার
ধারণা এই স্বাধীনতা চায় না। সে নাম লেখানো শেখানো অবধিই রাখতে চায় বা ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে জাতীয়তাবাদের পাঠ দেয়। যেমন সে চায় না, অনাহার থেকে মুক্তি। এরকম সে অনেক
কিছুই চায় না। আবার কেউ কেউ তো আছেই যারা তা চায়। যেমন ঋত্বিক চেয়েছিলেন আর্য পূর্ববর্তী ইতিহাসের সঙ্গে আধুনিক ভারতের
সংযুক্তিকরণ। যেমন, আজ মুষ্টিবদ্ধ হাত যুব চাইছেন ‘ভুখমারিসে আজাদি’। কিন্তু
স্বাধীনতার ধারণাকেই যেখানে অসাড় করে রাখা হয়েছে সেখানে এই পদ্ধতি কতটা কর্মক্ষম
হয়ে উঠবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তার উপর আছে কাঠামোর গোঁড়ামি। এই প্রসঙ্গে
উল্লেখ্য, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক নিজের উদ্যোগেই বেশ কিছু পাঠশালা চালু করেছেন পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ডের প্রান্তিক এলাকায়।
নিজের পুরস্কারের অর্থমূল্যও প্রদান করেছেন প্রান্তিকদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের
কাজে। আশা করি ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বরূপটি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। দলীয়তার
উপরে উঠে যে স্বাধীনতার অনুশীলন একান্ত জরুরি বলে মনে করি, স্বাধীনতার সৎকারের
স্বার্থেই। ঘটনাচক্রে এ-লেখায় বারবার কমিউনিজমে আস্থা রাখা ব্যক্তিত্বের কথা বা
কিছু ঘটনার কথা ফিরে এসেছে। কিন্তু দুটো কথা ভেবে তৃপ্তি পাই, যে, দল বা দলীয়
শৃঙ্খলা ইত্যাদি বিষয়ে সমালোচনা করা তো দূর, আলোচনা করার মতোই বুদ্ধি বা
যোগ্যতা আমার নেই। যে উদাহরণ ফিরে এসেছে তা আমাদের হাতের সামনেই আছে। ফলে আয়না
নিয়ে নাড়াচড়া করার চেষ্টা মাত্র। অপরটি হল, স্বাধীনতার আত্মা-মুক্তির বা
আত্মমুক্তির প্রসঙ্গে এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও মতাদর্শ নেই যার সামনে দাঁড়ানো যায়। আর
কিছু হোক বা না-হোক, নিদেনপক্ষে হাতে ওই আয়নাখানা তুলে নিয়ে ভাঙার স্বাধীনতা
অন্তত সেখানেই মেলে।
ভালো লাগলো সরোজ
ReplyDeleteসৌমনাদি, খুব ভালো লাগল প্রতিক্রিয়া পেয়ে। থ্যাংকু।
Deleteভালো লিখেছ সরোজদা।
ReplyDeleteথ্যাংকু ভাই। কখনও এ-নিয়ে আরো আলোচনা হবে।
Deleteগুরুত্বপূর্ণ লেখা। ভাবালো।
ReplyDeleteগুরুত্বপূর্ণ লেখা। ভাবালো।
ReplyDelete